ভূপেন হাজারিকার দুর্লভ ছবি ও অজানা-জানা ১০ তথ্য
প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

আজ ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫—আজ থেকে ১০০ বছর আগে, ১৯২৬ সালের এই দিনে আসামের সদিয়াতে জন্মেছিলেন এক শিল্পী। নাম তাঁর ভূপেন হাজারিকা। শিল্পী, কবি, সংগীত পরিচালক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সাংস্কৃতিক কর্মী—যত অভিধাই দেওয়া যায়, তার চেয়ে বড় হয়ে তিনি দাঁড়িয়েছেন একজন মানবতার কণ্ঠ হিসেবে।
ভূপেন হাজারিকার গান আজও শোনায় সংগ্রামের গল্প, ভালোবাসার রূপকথা আর আশার আলো। তাঁর গান কেবল সুরে বুঁদ হওয়ার জন্য নয়, বরং গান হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের অস্ত্র, হতাশায় জর্জরিত মানুষের স্বপ্ন দেখার ভাষা। উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষের যন্ত্রণার কথা তিনি যেমন গেয়েছেন, তেমনি গেয়েছেন মুক্তির গান। একসময় তাঁর কণ্ঠ হয়ে উঠেছিল আসামের পাহাড় থেকে গঙ্গা-যমুনার তীর পর্যন্ত, উত্তর-পূর্বের সঙ্গে সারা ভারতের সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধ।
সুরের জাদুকর
ভূপেন হাজারিকা ছিলেন অনবদ্য শিল্পী। বাংলা, হিন্দি, আসামিজ, নেপালি—বহু ভাষায় তাঁর গান ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিটি ভাষাতেই তিনি ছুঁয়েছেন হৃদয়ের গোপনতম আবেগ। দরাজ কণ্ঠের অধিকারী তিনি প্রথমে প্রবেশ করেন অসমিয়া চলচ্চিত্রে। ধীরে ধীরে তাঁর গান পৌঁছে যায় সর্বভারতীয় পরিসরে, পরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও।
বাংলাভাষী মানুষের কাছে ভূপেন হাজারিকা হয়ে ওঠেন গণসংগীতের কিংবদন্তি। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম থেকে শুরু করে বাংলাদেশ—যেখানেই প্রগতিশীল সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক আন্দোলন, সেখানেই তাঁর গান শোনা গেছে।
‘ভূপেন হাজারিকার কয়েকটি গান’
‘মানুষ মানুষের জন্য’
‘আমি এক যাযাবর’
‘বিস্তীর্ণ দুপারের অসংখ্য মানুষের’
‘হে দোলা হে দোলা’
‘সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনাতে নজরুল’
‘সহস্র জনে মোরে প্রশ্ন করে মোর প্রেয়সীর নাম’
‘আজ জীবন খুঁজে পাবি’
‘ও মালিক সারা জীবন কাঁদালে যখন’
‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’
‘সাগর সংগমে সাঁতার কেটেছি কত’
সর্বজনীন জনপ্রিয়তা
১৯৭০-এর দশকে ভূপেন হাজারিকার গান জনপ্রিয়তার নতুন ইতিহাস রচনা করে। তাঁর কালজয়ী গান ‘মানুষ মানুষের জন্য’ বিবিসির শ্রোতা জরিপে বিশ্বের সেরা ১০টি জনপ্রিয় গানের তালিকায় জায়গা করে নেয়। এর বাণীতে যে মানবিক বার্তা, তা ছাপিয়ে যায় সব কালের বিভাজন, সব সীমানা। তাঁর আরেকটি বিখ্যাত গান ‘বিস্তীর্ণ দুপারে অসংখ্য মানুষের হাহাকার’—যা পল রোবসনের ‘ওল ম্যান রিভার’-এর অনুপ্রেরণায় লেখা—আজও শুনলে মনে হয়, এটি শুধু আসাম বা ভারতের নয়, সমগ্র বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের আর্তনাদ।
ভূপেন হাজারিকার গান বাণী ও বিষয়বৈচিত্র্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বহুমুখী। তিনি আজীবন মানবতাবাদী, সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে মানবপ্রেমই তাঁর গানের মূলকথা। তাঁর গানের মধ্যে মানবিকতা, দেশপ্রেম ও ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার বহিঃপ্রকাশ চিরায়ত। বিশেষ করে ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’, ‘আমায় একজন সাদা মানুষ দাও, যার রক্ত সাদা’, ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি, ছুটে ছুটে আয়’, ‘গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা’, ‘শরৎ বাবু, খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে’, ‘সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনাতে নজরুল’ গানগুলো মানুষের মধ্যে জাতপাতে, বর্ণবাদ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ওঠার ডাক দেয়। প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের মতো প্রেম নিয়েও অনেক গান দেখতে পাই। এই যেমন ‘সহস্রজনে মোর প্রশ্ন করে’, ‘মাইয়া ভুল বুঝিস না, ও মাইয়া ভুল বুঝিস না’, ‘বিমূর্ত এই রাত্রি আমার, মৌনতার সুতোয় বোনা’ গানগুলো মানুষকে আবেগপ্রবণ জীবনের দিকে পথনির্দেশ করে।
২০১১ সালের ৫ নভেম্বর, ৮৫ বছর বয়সে ভূপেন হাজারিকা পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। কিন্তু তাঁর গান আজও বেঁচে আছে মানুষের কণ্ঠে, সংগ্রামের মিছিলে, প্রেমের আকুতি কিংবা আশার আলোয়। কয়েক বছর আগে ভারত সরকার তাঁকে মরণোত্তর ‘ভারতরত্ন’ সম্মানে ভূষিত করেছে। এ স্বীকৃতি কেবল তাঁর শিল্পীসত্তার জন্য নয়, বরং মানবতার প্রতি তাঁর অবদানের জন্যও। আজ জন্মদিন উপলক্ষেই তাঁর জীবন ও সংগীত সফরের কিছু অজানা গল্প, দেখে নেব তাঁর দুর্লভ কিছু আলোকচিত্র।
১.ভূপেন হাজারিকা সমাজতন্ত্রের প্রতি বিশ্বস্ত শিল্পী। তবে জীবনের শেষ ভাগে ডানপন্থী বিজেপির প্রতি সমর্থন দেন। ২০০৪ সালে গুয়াহাটি থেকে মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনে দাঁড়ান। পরে ভুলও স্বীকার করেছেন। তবে মানবতাবাদী সংগীতশিল্পী হিসেবেই তিনি সংগীতপ্রেমী মানুষের প্রিয়।
২. ভূপেন হাজারিকার জন্ম আসামের সাদিয়াতে ১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। ছোটবেলা থেকেই আসামের লোকজ গানের সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। এই গানগুলো গাইতে পছন্দ করতেন। শিক্ষাজীবনের শুরু আসামের সোনারাম, তেজপুর, ধুবড়ি ও বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫২ সালে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
৩. পল রোবসনের কথা শুনে, তাঁকে দেখে মোহিত হয়ে যান ভূপেন হাজারিকা। রোবসন নিগৃহীত হয়েছিলেন চারদিক থেকে। আমেরিকা থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলতে চেয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্র। হলিউড থেকে তিনি বিতাড়িত। স্টেজ শো করার ক্ষেত্রেও এসেছে বাধা। রেকর্ডিং কোম্পানিগুলোও তাঁর গান প্রকাশ করতে অনীহা প্রকাশ করেছে। এ সময়ই কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন পল রোবসন। শোনান ‘ওল’ ম্যান রিভার, হি ডোন্ট সে নাথিন্’। এই গানের আদলেই ভূপেন তৈরি করেছিলেন তাঁর অসাধারণ গানটি, ‘বিস্তীর্ণ দুপারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও...’। এ ছাড়া পিট সিগারেরও অনুরক্ত ছিলেন ভূপেন।
২০১১ সালের ৫ নভেম্বর, ৮৫ বছর বয়সে ভূপেন হাজারিকা পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। কিন্তু তাঁর গান আজও বেঁচে আছে মানুষের কণ্ঠে, সংগ্রামের মিছিলে, প্রেমের আকুতি কিংবা আশার আলোয়।
৪. শৈশবেই ভূপেন গীতিকার আনন্দীরাম দাস, পার্বতী প্রসাদ বড়ুয়া ও কমলানন্দ ভট্টাচার্যের মাধ্যমে স্থানীয় বরগীত, গোয়ালপাড়ার গান, চা–মজদুরের গান, বিহুগীতসহ গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন ও প্রভাবিত হন। পরবর্তীকালে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জ্যোতিপ্রসাদের প্রভাব পড়েছিল ভূপেনের মনে। হিন্দুস্তানি ক্ল্যাসিক্যাল সংগীত ও উচ্চাঙ্গ নৃত্যের ওস্তাদ বিষ্ণুপ্রসাদ রাভার হাত ধরেই সংগীতে পথচলা শুরু হয় ভূপেনের।
৫. গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে দাঙ্গাবিধ্বস্ত আসামে বিপ্লবী সংস্কৃতি সংগঠক বিষ্ণুপ্রসাদ রাভা, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, মধাই ওঝাদের সঙ্গে সারা আসাম ঘুরে গান করেছেন, দাঙ্গাবিরোধী গান করে দাঙ্গা থামিয়েছেন। এ ছাড়া প্রগতিশীল সংস্কৃতিসেবী জ্যোতিপ্রসাদ আগারওয়াল, আব্বাসউদ্দিন, সলিল চৌধুরী, বলরাজ সাহানি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বড়ুয়া প্রমুখের ছিলেন সহযাত্রী।
৬. বছর সংসার করার পর ১৯৬৩ সালে প্রিয়ংবদা প্যাটেল ও ভূপেন আলাদা হয়ে যান। কেন তাঁরা আলাদা হয়ে গেলেন, সে কথা ভূপেনের মৃত্যুর এক বছর পর কানাডাপ্রবাসী প্রিয়ংবদা বলেন আসামের একটি টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে। তিনি বলেন, লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে ভূপেনের প্রণয়ের কারণেই নাকি তাঁরা আর একসঙ্গে বসবাস করেননি। লতা মঙ্গেশকর কিন্তু তাতে খুব বিরক্ত হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন ভূপেনের ৩৯ বছরের সঙ্গিনী কল্পনা লাজমি।
ভূপেন হাজারিকার গান আজও শোনায় সংগ্রামের গল্প, ভালোবাসার রূপকথা আর আশার আলো। তাঁর গান কেবল সুরে বুঁদ হওয়ার জন্য নয়, বরং গান হয়ে উঠেছিল আন্দোলনের অস্ত্র, হতাশায় জর্জরিত মানুষের স্বপ্ন দেখার ভাষা।
৭. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর ভূপেনের গাওয়া ‘জয় জয় নবজাত বাংলাদেশ,/ জয় জয় মুক্তিবাহিনী/ ভারতীয় সৈন্যের সাথে রচিলে/ মৈত্রীর কাহিনি’ গানটি সবার হৃদয় জয় করে। বাংলাদেশ সম্বন্ধে ভূপেন হাজারিকা বলেছিলেন, তিনি ঢাকায় দেখেছেন বঙ্গ সংস্কৃতির স্ফুরণ। তিনি বাংলাদেশেই বঙ্গ সংস্কৃতির গভীরতা দেখেছেন।
৮. পড়াশোনা শেষে ভারতে ফিরে ভূপেন হাজারিকা গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। পরে তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা শুরু করেন। পাশাপাশি আইপিটিএর (ভারতীয় গণনাট্য সংঘ) সক্রিয় কর্মী ও নেতা হিসেবে গণনাট্যের কাজ চালিয়ে যান। এ সময়ই তাঁর গাওয়া গণসংগীতগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
৯. প্রিয়ংবদার সঙ্গে ভূপেনের বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি। কিন্তু তাঁরা আর একসঙ্গে থাকেননি। ভূপেন আরেকটি বিয়ে করতে ভয় পেতেন। তবে কল্পনা লাজমির সঙ্গে তাঁর ছিল অসমবয়সী প্রেম। কল্পনার মামা গুরু দত্ত ছিলেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার। কিশোর বয়স থেকেই কল্পনা লাজমি ভক্ত ছিলেন ভূপেন হাজারিকার। ব্যক্তিজীবনে অগোছালো, বেহিসাবি ভূপেনকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনেন কল্পনা। তিনি তাঁর ম্যানেজারও হন। ১৯৭৬ সালের দিকে কল্পনা সরাসরি ভূপেনের ফ্ল্যাটে চলে যান এবং একত্রে বাস করতে থাকেন। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে ভূপেন কল্পনাকে তাঁর সঙ্গী বলে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকেন। অনেক ছবির মধ্যে কল্পনা লাজমি ‘রুদালি’ নামের ছবিটিও পরিচালনা করেছিলেন। তাঁর সংগীতের দায়িত্বে ছিলেন ভূপেন।
১০. ২০১১ সালের ৫ নভেম্বর ভূপেন হাজারিকা মারা যান। এ বছর ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘ভারতরত্ন’ পদকে সম্মানিত হয়েছেন প্রয়াত ভূপেন হাজারিকা।