Advertisement

বান্দরবানের গহিনে একটি কুকুর যেভাবে গাইড হয়ে আমাকে পথ দেখাল

প্রথম আলো

প্রকাশ: ৭ আগস্ট, ২০২৫

24obnd

আমি পেশায় চিকিৎসক। তবে পেশাটা আপাতত শিকেয় তুলে ফুল টাইম ভ্রমণ করছি। ঘোরাঘুরির ভূতটা ঘাড়ে চেপেছিল ১৬ বছর আগে, তখন আমি ছাত্র। অবশ্য পাহাড় ভ্রমণ শুরু তারও দুই বছর পর, মানে ১৪ বছর আগে পাহাড়ের প্রেমে পড়া।

স্বাভাবিকভাবেই, শুরুতে প্রেম ততটা গভীর ছিল না। নয়া প্রেমিকের মতো মাঝেমধ্যে যেতাম মূলত পাহাড়ি শহর আর শহরের আশপাশের দু–একটা ঝরনা দেখতে। পাশাপাশি পড়াশোনাটাও চালিয়ে গেছি।

এভাবেই চলেছে ২০২০ সাল পর্যন্ত। তারপর এল করোনাকাল। মনোজগতে এল বিশাল পরিবর্তন। তত দিনে পেশাজীবনে ঢুকে গেছি। ফলে চেম্বারে ফাঁকি দিয়েই নতুন করে প্রকৃতি দেখতে শুরু করলাম একদম একাকী। ইংরেজিতে যেটাকে বলে ‘সলো ট্রাভেলার’। দেশ ঘুরে ঝরনা, ঝিরি, পাহাড়, খাল দেখতে শুরু করলাম একা একা, কখনো কখনো কোনো দলের সঙ্গে জুটে।

এর মধ্যেই খেয়াল করলাম, দল বেঁধে ঘোরার চেয়ে একা একাই প্রকৃতির সান্নিধ্য বেশি উপভোগ করছি, স্থানীয় মানুষের সঙ্গে ভালো সময় কাটাচ্ছি। আর একা ঘোরার আরেকটা সুবিধা হলো, ভ্রমণের সময় ধরাবাঁধা থাকছে না।

২০২১ সালে বান্দরবানের লামায় গহিন পাহাড়ি এলাকায় ম্রো শিশুদের জন্য গড়ে উঠল চেননৈ স্কুল। ফলে প্রতি মাসে ওই শিশু আর পাহাড়ের টানে একরকম ঘরছাড়া। সেই পথচলায় কখনো স্থানীয় মানুষের সাহায্য নিয়ে কিংবা পাহাড়ি পাড়ার বিশ্বস্ত কুকুর সঙ্গী করেই চলি বনপাহাড়ের অজানা রহস্য সন্ধানে।

কুকুরও যে দারুণ ভ্রমণসঙ্গী হতে পারে, এটা আমার শহুরে অনেক বন্ধুস্বজনকে বিশ্বাস করাতে পারিনি। হয়তো প্রাণীদের সঙ্গে আমাদের এখনো তেমন সুসম্পর্ক গড়ে ওঠেনি কিংবা আমরা তাদের বুঝে উঠতে পারিনি বলেই তাঁরা বিশ্বাস করেননি।

তবে সেই করোনাকালে যখন মানুষ ঘরবন্দী, রেস্তোরাঁগুলো বন্ধ, তখন পথের কুকুরসহ অন্যান্য প্রাণী দিনের পর দিন অভুক্ত থেকে কাঁদছিল। তাই তখন রাতের পর রাত ওদের মধ্যে খাবার বিলিয়েছি নিজে রান্না করে। বেশ ভালো একটা বন্ধন গড়ে উঠেছিল আমাদের।

বলছিলাম পাহাড়ে কুকুরকে বন্ধু হিসেবে পাওয়ার কথা। একবার নয়, বারবার বন্ধু হিসেবে পেয়েছি কুকুরকে। আমার মতে, কুকুর কেবল বন্ধু নয়, সেরা গাইডও। আমি পেশাদার ব্লগার, ভ্লগার, নির্মাতা বা কনটেন্ট ক্রিয়েটর নই। ভ্রমণে শখের বশে টুকটাক ভিডিও করি বা ছবি তুলে শেয়ার করি একান্তই স্মৃতি সংরক্ষণের তাগিদে। সম্প্রতি আমার একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যার ভিউ ছাড়িয়েছে ৩০ লাখের ঘর!

হ্যাঁ, সংখ্যাটা ৩০ লাখ! আমার কাছে রীতিমতো অবিশ্বাস্য। এই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে মূলত আমার এক কুকুর বন্ধুর কারণে। সে–ই আমার গাইডের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেছে গহিন এক পাহাড়ি পথে।

গত ১৩ জুলাই একাকী বেরিয়েছিলাম বান্দরবানের থানচি উপজেলার পথে। উদ্দেশ্য ছিল আলীকদম, তিন্দু হয়ে দেশের সুন্দরতম নদ সাঙ্গু ধরে বাঘেরমুখ পাড়ায় নেমে অবগাহন করব লাংলোক ঝরনায়।

কিন্তু বাঘেরমুখ পাড়ায় গিয়ে ডান দিকে লাংলোক হলেও কিসের টানে জানি না, চলে গেলাম বাঁ দিকে। সামনেই দেখা পেলাম সেই কুকুর বন্ধুর। ভালোবেসে পরে যার নাম রেখেছি রকি।

রকিকে ডাকতেই কাছে এসে বসে আদর নিতে লাগল। তারপর সামনে এগোলাম হুট করে। ঠিক করলাম, গুগল ম্যাপ দেখে যাব ছাওদাং পাড়া। যেখান থেকে মন ভরে দেখব দেশের অন্যতম সুন্দর শৈনগং ঝরনা। পাশাপাশি এখানে দুটি ঝরনা নতুন করে লোকচক্ষুতে ধরা পড়েছে—রণদায়ক ও বখ্যিয়াং ঝরনা। এই দুটিও দেখব বলে ঠিক করলাম।

যেমন ভাবা তেমন হাঁটা। কিন্তু হায়! এই রাস্তা যে আমার অচেনা। ঝরনা, ঝিরি, জুমপাহাড় ডিঙিয়ে এই জনমানবশূন্য গহিন বন-পাহাড়ে পথ পাব কী করে! গুগল ম্যাপও যে এখানে পথহারা পথিক!

আর তখনই বন্ধু হয়ে এল রকি। সামনে এগিয়ে ইশারায় যেন বলল, ‘আমি তো আছি, বন্ধু! ভয় কিসে!’

বাঘেরমুখ পাড়া থেকে ছাওদাং পাড়া তিন ঘণ্টার রাস্তা। যাঁরা নিয়মিত পাহাড় ভ্রমণ করেন কিংবা হাঁটাহাঁটির অভ্যাস আছে, তাঁদের জন্যও আড়াই ঘণ্টা পাক্কা।

অথচ মহাশয় আমাকে পুরোটা পথ নিয়ে এলেন মাত্র ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিটে। কারণ, তিনি তো আর হেঁটে হেঁটে চলেন না, তিনি থাকেন দৌড়ের ওপর। ফলে আমাকেও দৌড়ের ওপর রেখে গন্তব্যে নিয়ে এলেন এত অল্প সময়ে। এই যাত্রার প্রতিটা সেকেন্ড, প্রতিটা পদক্ষেপ ছিল অ্যাডভেঞ্চারে ভরপুর।

মজার বিষয় হলো, রাস্তার প্রতিটা বাঁকে, ঝিরিতে মূত্র ত্যাগ করে করে এগিয়েছে রকি। পাশাপাশি পায়ের ধারালো নখর দিয়েও কেটেছে আঁচড়। ও আদতে চিহ্ন রেখে এগোচ্ছিল, যাতে পরবর্তী সময়ে নিজের মূত্রের গন্ধ চিনে চলতে পারে। মূত্রত্যাগের সময় ঠিক একই জায়গায় রকি শুঁকেও নিচ্ছিল।

তাতেই বুঝে নিলাম, এই রাস্তা ধরে ও আগেও গেছে কিংবা ওর স্বজাতির কেউ রেখে গেছে মূত্রচিহ্ন। ফলে এখানে যে রকিই সবচেয়ে অভিজ্ঞ গাইড, তাতে আর সন্দেহ নেই এবং আমার আর চিন্তাও থাকল না।

পাহাড়ি পথে সন্ধ্যা নামে নামে। রকির পেছনে ছুটতে ছুটতে ভীষণ হাঁপিয়ে উঠেছি। তাই অর্ধেক পথে গিয়ে থামলাম। রকি তখন বেশ খানিকটা এগিয়ে ছিল। কিছুক্ষণ পর দেখি, ও আবার ফিরে আসছে। বুঝলাম, কিছুটা পথ গিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে আমার দেখা না পেয়ে আবার ফিরে এসেছে।

তখন আমার মনে যে কী এক অনুভূতি খেলা করল, তা বলে বোঝাতে পারব না। তখন মনে হলো, এমন সন্ধ্যার মুখে জনবিরল বনপাহাড়ে আমার কোনো ভয় নেই। আর ঠিক তখন রকি আমার মনে বন্ধুর স্থানটা দখল করে নিল। কিছুক্ষণ দম নিতেই রকি আবার এগোতে শুরু করল আর আমাকে বুঝিয়ে দিল—‘আবার ছুটতে হবে, বন্ধু!’

তথাস্তু, আমি এগোলাম। ছাওদাং পাড়া উঠতে শেষ উঁচু পাহাড়ের নিচে যে ঝিরিটা, সেখানে রাস্তাটা চার ভাগ হয়েছে। আমি তো আমি, রকিও সম্ভবত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। তারপর চারদিকে কমপক্ষে ৫০ বার শুঁকেটুকে, মূত্রত্যাগ করে হুট করে পাহাড়ে উঠতে শুরু করল। আমিও নিশ্চিন্তে ওর পিছু নিলাম। কারণ, জানি, রকি ভুল করবে না।

বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছে রকি। পাহাড়ের পায়ে সূর্যের শেষ কিরণ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে পৌঁছে দিল ছাওদাং পাড়ায়, ঠিক ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের মাথায়। ছাওদাং পাড়ায় একদল পর্যটক ছিলেন, তাঁদেরকে রকির কীর্তি বললাম। ভিডিওগুলো দেখে তাঁদের চক্ষু চড়কগাছ।

ফ্রেশ হয়ে ডিম চড়ালাম কড়াইয়ে। পাহাড়ি এ পাড়ায় তেমন কোনো খাবার নেই। ডিম–ভাত মেখে দুই বন্ধু খেলাম। সঙ্গে বাঁশকোড়ল আর নাপ্পি। এত অল্পতেই রকি কৃতজ্ঞ, অথচ তখনো ও ক্লান্ত। ওকে বিশ্রাম দিয়ে রাতের আকাশের নিবু নিবু তারা দেখছিলাম। ভাবছিলাম, মানুষে মানুষে যখন এত বিভাজন, তখন পাহাড়ের এই কুকুরই কিনা আমাকে বন্ধু বানিয়ে ফেলল!

আরও চার দিন এ পাড়ায় থাকব। তাই পরদিন রকিকে ওই পর্যটক দলের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলাম ওর নিজের পাড়ায়। এই চার দিনের মধ্যে ঝরনায় ড্রোন হারিয়ে মুখ গোমড়া করে যখন একাকী ফিরতি পথে হাঁটছি, তখন বাঘেরমুখ পাড়ায় আবারও দেখা আমার রকির সঙ্গে। এবার সব ঘটনা জানালাম ওর মনিব মারমা এক দাদাকে। উনি বললেন, ‘ও তো এমনই।’

কেকটেক খাইয়ে আদর দিয়ে বিদায় নিলাম রকির কাছ থেকে। আবার নিশ্চয়ই দেখা হবে পাহাড়ের এই বিশ্বস্ত কুকুর বন্ধুর সঙ্গে, যার নাম দিয়েছি রকি।

Lading . . .