প্রকাশ: ২ জুলাই, ২০২৫

ষড়ঋতুর দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। একেক ঋতুতে তার সৌন্দর্যে যোগ হয় একেক রং। শীতে যেমন ঘন সবুজ আর হলুদ, বর্ষায় তেমনি রুপালি। গ্রীষ্ম আর শীতে ফসলের সমারোহ দেখে বোঝার উপায় নেই, বর্ষায় ঢেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়ে তীরে। প্রকৃতিপ্রেমীরা বর্ষা ঋতুকে ভালোবাসেন। বৃষ্টির কারণে চারদিকে সবুজের সমারোহ, মেঘে ঢাকা আকাশ এবং বাতাসের সতেজতা যে কাউকে পাগল করে তোলার জন্য যথেষ্ট। এ বর্ষায় আপনিও ঘুরে আসতে পারেন উল্লেখিত যে কোনো হাওড়ে। অনুভব করতে পারবেন বর্ষার রূপ।
টাঙ্গুয়া হাওড় : ‘নয় কুড়ি কান্দা ছয় কুড়ি বিল’ হিসাবে পরিচিত জীববৈচিত্র্যে ভরপুর সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়া হাওড়। এ হাওড়ে রয়েছে সারি সারি হিজল ও করচগাছ এবং নলখাগড়ার বন। একদিকে মেঘালয় পাহাড়। বাকি তিন দিকে তিনটি উপজেলা তাহিরপুর, মধ্যনগর ও ধর্মপাশা। ৫১টি বিল আর ৮৮টি গ্রামবেষ্টিত টাঙ্গুয়ার হাওড়ের আয়তন বর্ষায় ও হেমন্তে বাড়ে-কমে। এ হাওড়ে রয়েছে প্রায় ২০০ প্রজাতির গাছগাছালি। ছয় কুড়ি বিলের কারণেই টাঙ্গুয়া ‘মাদার ফিশারিজ’ হিসাবে পরিচিত। বিশ্বের ১ হাজার ৩১টি রামসার সাইটের মধ্যে টাঙ্গুয়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট। বর্ষা ও হেমন্ত দুই ঋতুতেই টাঙ্গুয়া আকর্ষণীয়। বর্ষায় জল থইথই হাওড়কে মনে হয় সাগর। চার বছর ধরে হাওড়ে হাউস বোটসহ নানা ধরনের সজ্জিত ইঞ্জিনচালিত নৌকার ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে হাওড় ভ্রমণ এখন অনেক সহজ। টাঙ্গুয়ার হাওড়ের প্রধান দুটি পাখির অভয়ারণ্য হলো লেউচ্ছামারা ও বেরবেড়িয়ার বিল। এ হাওড় শুধু একটি জলমহাল বা মাছ প্রতিপালন, সংরক্ষণ ও আহরণেরই স্থান নয়। এটি একটি মাদার ফিশারী। হিজল করচের দৃষ্টিনন্দন সারি এ হাওড়কে করেছে মোহনীয়।
যেভাবে যাবেন : প্রথমেই পৌঁছাতে হবে সুনামগঞ্জ জেলা শহরে। সুনামগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড থেকে সাহেববাজার ঘাট পর্যন্ত রিকশায় যান। বর্ষাকালে শহরের সাহেব বাড়ি নৌকা ঘাট থেকে ইঞ্জিন বোট বা স্পিড বোটে সরাসরি টাঙ্গুয়া যাওয়া যায়। রাতে থাকার জন্য নৌকা ভাড়া করলে প্রয়োজনীয় বাজার সদাই করে নেবেন। আর বিলাসবহুল ইঞ্জিনচালিত নৌকাগুলোতে হাই কমোডসহ বাথরুম, ছাদে তেরপলসহ অনেক সুবিধা আছে সেগুলোর।
নিকলী হাওড় : বর্ষার এ মৌসুমে বেড়াতে যাওয়ার অন্যতম স্থান হলো নিকলী হাওড়। এটি বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। এর নাম এসেছে নিকলী উপজেলা থেকে, যেখান থেকে হাওড়টির উৎপত্তি হয়েছে। নিকলী ছাড়াও এ হাওড়ের পরিধি পার্শ্ববর্তী মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও ইটনা উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব ১১০ কিলোমিটার। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে যতগুলো হাওড় আছে তার মধ্যে নিকলী হাওড়ে ভ্রমণ করাটা পর্যটকদের কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। চারদিকে অথই পানি, সেই পানির মধ্যে হাওড় অঞ্চলের মানুষের জনজীবন। বিশেষ করে বর্ষার এ মৌসুমে হাওড়জুড়ে গলা ডুবিয়ে থাকা হিজলগাছের সারি বা পানির নিচ থেকে জেগে ওঠা করচের বন কিংবা শুশুকের লাফ-ঝাঁপ মুহূর্তেই আপনার মন ভালো করে দেবে। কিশোরগঞ্জ হাওড় এমনই। হাওড়ে নৌকা চলতে শুরু করা মাত্রই হারিয়ে যেতে হয় জলরাশির রাজ্যে।
যেভাবে যাবেন : প্রথমেই পৌঁছতে হবে কিশোরগঞ্জ জেলা শহরে। এরপর কালিয়াচাপরা সুগার মিল এলাকা থেকে সিএনজি অটোরিকশায় করে নিকলী হাওড় চলে যাবেন। সময় লাগবে ঘণ্টাখানেক। আবার পুলের ঘাট নেমেও আধা ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছতে পারবেন হাওড়ে। নিকলীতে থাকার জন্য বেশ কিছু আবাসিক হোটেল আছে। চাইলে সেখানে রাতযাপন করতে পারবেন। তবে অনেকেই সারা দিন হাওড় ভ্রমণ করে সন্ধ্যা হতেই ফিরে যান নিজ গন্তব্যে।
চলনবিল : ভরা বর্ষায় চলনবিল হয়ে ওঠে জল-থইথই। চলনবিল শুধু একটি বিল নয়, অনেক বিল, খাল ও নদী নিয়ে গড়ে ওঠা জলাভূমি। দেশের বৃহত্তম বিল এটি। নাটোর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলার অনেক ছোট বিল আর ৪৭টি নদী নিয়ে চলনবিল। বর্ষায় পানির প্রবাহ বেড়ে ছোট ছোট বিল ও নদীগুলো একসঙ্গে সুবিশাল বিলের রূপ নেয়। তিন জেলা হলেও চলনবিলের বড় অংশ রয়েছে নাটোর জেলার সিংড়া ও গুরুদাসপরে। চলনবিলের দর্শনীয় জায়গাগুলো বর্ষাকালেই বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। ইঞ্জিনচালিত নৌকা, বৈইঠার নৌকা, পালতোলা নৌকায় ঘুরে দেখা যায় বিলের বিভিন্ন অংশ। এর অন্যতম দর্শনীয় জায়গা হজরত ঘাসী দেওয়ান (রহ.)-এর মাজার, যা দেশব্যাপী পরিচিত তিশিখালীর মাজার নামে। বর্ষায় যখন চারদিকে পানি থইথই করে, তখন দ্বীপের মতো জেগে থাকে এ মাজারটি। এর চারদিকে সারি সারি নৌকা বাঁধা থাকে। তা ছাড়া চলনবিলের আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হলো, কংক্রিটে নির্মিত সাবমার্সিবল সড়ক। সিংড়া পয়েন্ট থেকে শুরু হয়ে সড়কটি চলে গেছে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার দিকে। ভরা বর্ষায় ডুবে থাকা প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কে চলাচল করা যায়। গুরুদাসপুর উপজেলার বিলসা ব্রিজ এখন আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে ডুবে থাকা রাস্তাটির জন্য। আশপাশে জনপদ না থাকলেও বিলসা একটি গ্রাম। বর্ষায় বিলসার চারদিক ডুবে থাকে পানিতে। দ্বীপের মতো এ জায়গায় পর্যটকদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ‘স্বর্ণদ্বীপ’ নামে একটি কৃত্রিম দ্বীপ। অনেক ছোট বিল আর ৪৭টি নদী নিয়ে চলনবিল। বছরের পর বছর চলনবিলে পাওয়া নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, মাছ ধরার বিভিন্ন সরঞ্জামসহ অনেক দুর্লভ জিনিস নিয়ে গড়ে উঠেছে চলনবিল জাদুঘর। গুরুদাসপুরের খুবজিপুরে গ্রামে গড়ে ওঠা এ জাদুঘরও অনেক পর্যটকের কাছে আকর্ষণীয় জায়গা। এ ছাড়া গুরুদাসপুরের বিলসা ও সিরাজগঞ্জের তাড়াশের কুন্দইলের বুক চিরে বয়ে চলা বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের তাড়াশ এলাকার ৯ ও ১০ নম্বর ব্রিজ এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও আকর্ষণ করবে আপনাকে।
যেভাবে যাবেন : দেশের যে কোনো জায়গা থেকে চলনবিল দেখতে আসতে হবে নাটোরের গুরুদাসপুরের কাছিকাটা নয়াবাজার অথবা নাটোর শহরে। কাছিকাটা থেকে বিলসা দেখে সেখান থেকে দেড় থেকে দুই হাজার টাকায় নৌকা ভাড়া করে পর্যটকরা আসতে পারবেন মূল চলনবিল দেখতে। এ ছাড়া নাটোর শহরের মাদ্রাসা মোড় থেকে এক ঘণ্টা দূরত্বে প্রথমে বাসে বা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় ৫০ টাকা ভাড়ায় এবং পরে সিংড়ার চলনবিল গেট থেকে পেট্রোবাংলা পয়েন্ট পর্যন্ত ১০ থেকে ২০ টাকা ভাড়ায় চলনবিল পয়েন্টে যাওয়া যাবে। পয়েন্ট থেকে দেড় থেকে দুই হাজার টাকায় বিভিন্ন আকারের নৌকা ভাড়া নিয়ে এক থেকে দেড় ঘণ্টায় ঘুরে দেখা যাবে চলনবিলের বিশাল অঞ্চল।
হাকালুকি হাওড় : চির সবুজে আচ্ছাদিত পাহাড়। বৃষ্টিস্নাত চা বাগানে গজিয়ে ওঠা নতুন কুঁড়ি সিলেট ছাড়া বিশ্বের আর কোথায় পাওয়া যাবে না প্রকৃতির এমন মোহনীয় অপরূপ দৃশ্য। প্রকৃতির এমন অতুলনীয় স্থান এশিয়ার এক বৃহত্তম হাওড়, হাকালুকি হাওড়। সিলেটের মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত। এ হাওড়ের আয়তন ২০,৪০০ হেক্টর। ২৩৬টি বিল নিয়ে এ হাকালুকি হাওড়। বিলগুলোতে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। চারদিকে শুধু পানি আর পানির খেলা। সে এক অপরূপ দৃশ্য। বর্ষাকালে ২৩৮টি বিল ও ১০টি নদী একিভূত এ হাওরের রূপ ঠিক যেন ভাসমান সাগর। আদিগন্তু বিস্তৃত জলরাশি। এ সময় হাকালুকি হাওড়ের বিলের পাড় ও কান্দায় বিদ্যমান জলাভূমি, বন পানির নিচে ডুবে গিয়ে সৃষ্টি করে ডুবন্ত বন যা ব্যবহৃত হয় মাছের আশ্রয়স্থল হিসাবে। বর্ষাকালে হাকালুকি হাওড় পাড়ে বসবাসরত মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয় এক অন্যরকম উন্মাদনা। যোগাযোগ ব্যবস্থায় বাহন হিসাবে স্থান করে নেয় দেশীয় দাঁড়বাহী ও ইঞ্জিনচালিত নৌকা। জেলেরা মেতে ওঠে মাছ ধরার উৎসবে। জলের মাঝে মাঝে দুই-একটি বর্ষীয়ান হিজল, তমাল বৃক্ষ। এ বর্ষা মৌসুমেও দেখা পাবেন কিছু অতিথি পাখির।
যেভাবে যাবেন : রাজধানী ঢাকার কমলাপুর ও ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশন থেকে প্রতিদিন ট্রেন ছাড়ে সিলেটের উদ্দেশে। বাসে যেতে চাইলে অনেক বাস আছে। আপনি যদি কুলাউড়া নেমে যান তবে ভালো। কুলাউড়া থেকে অটোরিকশায় সরাসরি হাওড়ে চলে যেতে পারেন। অথবা সেখানে নেমে অটোরিকশা নিয়ে অথবা বাসে চলে আসতে পারেন বড়লেখা। বড়লেখা গেলে আরও পাবেন মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত। আবার যদি সরাসরি ট্রেনে যেতে চান তবে কুলাউড়া স্টেশন অথবা ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও স্টেশন থেকে অটোরিকশা করে হাকালুকি যেতে পারেন।
আরও পড়ুন