Advertisement

প্রকৃতি আর পথের প্রাণী: ঢাকার লুকোনো সৌন্দর্য

ডেইলি স্টার

প্রকাশ: ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ছবি: সাকিব রায়হান
ছবি: সাকিব রায়হান

আপনি কি কখনো খেয়াল করেছেন, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কিছু মানুষ হঠাৎ একটা পথবিড়ালকে আদর করার জন্য থমকে দাঁড়ায়? এই ক্ষুদ্র ব্যাপারটিতে আমি ভীষণ আনন্দ পাই। ব্যস্ত সময়ের মধ্যে কেউ এক সেকেন্ডের জন্য পথের কোনো প্রাণী বা প্রকৃতি দেখতে থমকে যায়—এই ব্যাপারটি আমার জন্য ভীষণ আনন্দের। ঢাকার মতো ব্যস্ত শহরে মানুষের পাশাপাশি অন্য প্রাণীদের জন্য বেঁচে থাকা সত্যিই কঠিন। তবুও যখন ভাবি, এখনো কিছু মানুষ আছে যারা প্রকৃতি ভালোবাসে এর জন্য কাজ করেন, তখন এটাই আমার দিনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত হয়ে ওঠে।

গরম আর রোদ ঝলমলে এক বৃহস্পতিবারের দুপুরে আমি গুলশান ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। প্রকৃতির সঙ্গে গভীর সম্পর্কের খাতিরে সবুজে ঘেরা পার্ক আর গাছ-পালা ঘেরা ফুটপাথ ধরে হাঁটতে আমি বেশ ভালোবাসি। সেদিন কফি নিতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, এক তরুণ ছেলেকে। তিনি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন পার্কের পুকুরপাড়ের উঁচু গাছগুলোর দিকে স্থির তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছিল, তিনি যেন সবুজের মাঝে বিভোর হয়ে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছেন।

তার সঙ্গে গিয়ে কথা বলতেই জানালেন, 'এই সবুজ পাতাগুলোর দিকে তাকালেই আমি শান্তি আর স্বস্তি পাই'। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলেও তিনি নিজের জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানালেন। তার জীবন খুবই অগোছালো এবং এই ছোট্ট আশ্রয়গুলোই তার একমাত্র নীরবতার জায়গা। তিনি বড় হয়েছেন শহরের উপকণ্ঠে, বাবা-মায়ের সঙ্গে ছোট্ট এক ফার্মহাউসে। এখন তারা নেই। তিনি চলে এসেছেন শহরে। এই শহরের অন্য সবার মতো ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দৌড়ঝাঁপের জীবনে ঢুকে গেছেন। গাছ, পাখি বা জলাশয় ঢাকায় খুবই বিরল দৃশ্য। কিন্তু এসব তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় শৈশবের বন্ধু আর পরিবারের স্মৃতির কাছে। প্রকৃতির সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক নিয়ে কথা বলতে বেশ ভালো লাগছিল। চলে যাওয়ার সময় তিনি বললেন, 'আমার মনে হয়, সবাইকে গাছ বাঁচানোর জন্য কাজ করা উচিত!' এ কথা শুনে আমার মনে হলো, তার মতো মানুষরা এগিয়ে এলেই পৃথিবী আরও সুন্দর আর সবুজ হয়ে উঠবে।

কিছু অভিভাবক শিশুদের রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়ার বদলে নিয়মিত পার্কে নিয়ে যান। শিশুরা যেন প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক তৈরি করতে পারে, সেজন্যই তারা পার্ক বা প্রকৃতির কাছাকাছি জায়গা বেছে নেন। সারি সারি বহুতল ভবনে ঠাসা এই শহরে একটু সবুজ খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। এর মাঝেই এই অভিভাবকেরা চান তাদের সন্তানরা প্রকৃতির বৈচিত্র্যের মাঝে বেড়ে উঠুক। তারা নিজেদের শৈশবে যেমন এসবের মাঝে আনন্দ পেতেন, তেমনি চান যে মাটি আর প্রাণীদের সঙ্গে খেলতে খেলতে যেন তাদের সন্তানেরাও সেই আনন্দ অনুভব করুক।

দুই সন্তানের মা রেশমা বললেন, 'আমি চাই ওরা জানুক, নিজেদের ভবিষ্যতের জন্যই প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা উচিত'। যেই অভিভাবক সবুজকে গুরুত্ব দেন, তিনি এমন এক সন্তানকে বড় করেন যে বড় হয়ে সবুজকে ভালোবাসে। যতই কৃত্রিম খেলার জায়গা বা ভিডিও গেমস আসুক না কেন, গাছের নিচে কাদামাটির সঙ্গে খেলাই হলো শৈশবের আসল আনন্দ। যেই ছোট্ট শিশুরা শৈশবে এমন আনন্দ অনুভব করেছে, ভবিষ্যতে হয়তো তারাই পৃথিবী রক্ষায় সবার আগে এগিয়ে আসবে।'

আশেপাশে দেখা যায় বয়স্করা অক্সিজেন নিতে সবুজের পথে হাঁটতে বের হন। জিজ্ঞেস করলে বেশিরভাগই বলেন, কংক্রিটের ভিড়ে তাদের দম বন্ধ লাগে, এর মাঝে গাছপালা তাদের জীবনে শান্তি এনে দেয়। প্রকৃতির মাঝেই তারা খুঁজে পান প্রশান্তি আর সতেজতা।

আমি লক্ষ্য করেছি যে, জেনারেশন জেড বা 'জেন জি' নামে পরিচিত কিশোর-কিশোরীদের অনেকেই প্রকৃতিকে ভালোবাসে, প্রকৃতি রক্ষায় কাজ করে। আমি মাঝেমধ্যেই তাদের দেখি রাস্তার কোনো ছোট্ট বিড়ালছানা বা কুকুরকে আদর করতে থেমে যাচ্ছে। এখন অনেক মানুষকেই দেখা যায় যারা প্রকৃতির জন্য আন্দোলন করছে, ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করছে।

১৮ বছর বয়সী এক কিশোরী, পথের প্রাণীদের খাবার খাওয়াতে খাওয়াতে আমাকে বলল, 'আদর করুন, একটু ভালোবাসুন। হাত তো পরে ধুয়ে ফেলাই যাবে!' তার সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিল, যারা প্রাণীদের সঙ্গে খেলছিল আর আদর করছিল। বর্তমানে এটি হয়তো ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে। তবে তারা মনে করে এত সুন্দর ট্রেন্ড আর হয় না। তাদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানতে পারলাম, তারা একসঙ্গে দল বেঁধে রাস্তা পরিষ্কার করে, পথের প্রাণীদের উদ্ধার করে এবং গাছ লাগায়। এই প্রজন্মের প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা দেখে আমার ভেতর গর্বে ভরে উঠলো, কারণ আমিও তাদেরই একজন, যে প্রকৃতির মাঝেই স্বস্তি খুঁজে পায়। যাওয়ার সময় তারা বলে উঠল, 'পিতৃতন্ত্র ধ্বংস করো, পৃথিবী নয়।'। যদি আমরা সবাই মিলে কাজ করি, হয়তো সত্যিই তা সম্ভব। কীভাবে প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করতে হয়, এই উপায় বের করতে পারলে হয়তো প্রকৃতি আর কংক্রিট একসঙ্গে খুব ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে।

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম

Lading . . .