চট্টগ্রামে অনলাইন পশুর হাটে ৪ হাজার খামারি
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজেদের পেজে গত ২০ মে দেশি লাল গরু ‘তুফান’-এর ছবি পোস্ট করেছিলেন আরবিএস অ্যাগ্রো ফার্মের কর্ণধার রবিউল হক চৌধুরী। পরদিন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মরত আবুল কালাম আজাদের ফোন পান তিনি। জানান, গরুটি পছন্দ হয়েছে। দরদাম মিলে গেলে কিনে নেবেন। যেমন কথা, তেমন কাজ।
২১ মে পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে খামারে হাজির হন আবুল কালাম আজাদ। দরদাম করে ২ লাখ ২০ হাজার টাকায় কিনে নেন গরুটি। এ ঘটনার বিবরণ দিয়ে আরবিএস অ্যাগ্রো ফার্মের কর্ণধার রবিউল হক চৌধুরী বলেন, পবিত্র ঈদুল আজহার আমেজ শুরু হওয়ার পর থেকেই তিনি নিয়মিত কোরবানির পশুর ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করছেন। এতে দারুণ সাড়া মিলেছে। ৬০টির মধ্যে ৩৫টিই বিক্রি হয়ে গেছে। অনেকেই অনলাইনে পছন্দ করে রাখছেন। পরে খামারে এসে যাচাই করে কিনে নিচ্ছেন।
রবিউল হক চৌধুরী একজন পেশাদার ক্রিকেট আম্পায়ার। ২০১৬ সালে দুবাইয়ে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও আয়ারল্যান্ডের মধ্যকার টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ম্যাচে আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর শারীরিক অসুস্থতার কারণে সেই পেশা ছেড়ে ২০১৮ সালে গরুর খামার দেন। শুরুতে ১২টি গরু ছিল। এরপর ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে খামারের পরিধি। এর মধ্যে করোনাকালে তিনি অনলাইনে ৫ কেজি করে মাংস বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন। করোনার ঘরবন্দী সময়ে সাড়াও মেলে বেশ।
রবিউল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর ঈদ উপলক্ষে অনলাইনে বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। এ বছর চট্টগ্রামের লাল গরু (আরসিসি), শাহি ওয়াল, হলিস্টিন ফ্রিজিয়ান ষাঁড় প্রস্তুত করেছেন। তাঁর খামারে সবচেয়ে দামি গরু সাড়ে চার লাখ টাকা, আর সর্বনিম্ন ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
অনলাইনে দেখে গবাদিপশু কেনাকাটা এখন বেশ জনপ্রিয়। অনেকে হাটের ঝামেলা এড়াতে আগেভাগেই খামার থেকে গরু কিনে রাখছেন। কেনা গরু খামারেই রাখা যায়। অবশ্য খামারে গরুর দামে ভারসাম্য থাকলেও গতবারের চেয়ে কিছুটা বেশিমোহাম্মদ আলমগীর, জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম
শুধু রবিউল হক চৌধুরী নন, চট্টগ্রাম ক্যাটেল ফার্মাস অ্যাসোসিয়েশন ও প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসাব বলছে, অন্তত ৪ হাজার খামারি ঈদ উপলক্ষে অনলাইনে সক্রিয়। তাঁরা নিয়মিত কোরবানির পশুর ছবি-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করছেন। কেউ কেউ দাম উল্লেখ করে লিখছেন, ‘আলোচনা সাপেক্ষে’। ক্রেতারা হাটের ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই পছন্দের গরু কিনছেন। এ বিক্রি চলবে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত।
অনলাইনে সক্রিয় থাকার সুফল কেমন, তা বোঝা যাবে সিটি অ্যাগ্রোর কর্ণধার এনামুল হকের বর্ণনায়। এবার ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন জাতের ১৩০টি গরু প্রস্তুত করেছিলেন তিনি। ইতিমধ্যে ১১০টি গরু বিক্রি হয়েছে। সব কটি গরুর ছবি, ভিডিও পোস্ট করেছেন ফেসবুকে। এর মধ্যে ‘বাঁধা’ ক্রেতা যেমন গরু নিয়েছেন, ঠিক তেমন অনলাইনে দেখে গরু কিনেছেন অনেকে।
২০২০ সালে খামারে পশু লালন-পালন শুরু করেন এনামুল হক। ফেসবুকে ‘সিটি অ্যাগ্রো’ নামে পেজ খুলে প্রচারণা শুরু করেন। করোনাকালে মূলত ব্যবসা ও পরিচিতি পান। এরপর ধারাবাহিকভাবে বিক্রি বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে খামারের আকার। এনামুল হক জানান, এবার সবচেয়ে বড় গরু বাহাদুরের দাম উঠেছিল সাত লাখ টাকা। অনলাইনে দেখে এক ক্রেতা সম্প্রতি এটি কিনে নেন। এ ছাড়া ১০টির মতো গরু বিক্রি করেছেন সরাসরি ওজন (লাইভ ওয়েট) পদ্ধতিতে। প্রতি কেজি মাংসের দাম পড়েছে ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০ টাকা।
সিটি অ্যাগ্রোতে গিয়ে দেখা যায়, এক থেকে দেড় লাখ টাকা দামের মাঝারি আকারের ২৫টি গরু অবশিষ্ট রয়েছে।
অন্যদিকে এশিয়ান অ্যাগ্রোও ফেসবুকে বেশ সরব। এ খামারে এবার ২০০ গরু উঠেছিল। সব মাঝারি ও ছোট আকারের। ইতিমধ্যে ১৯৫টি বিক্রি হয়ে গেছে। খামারের স্বত্বাধিকারী ওয়াসিফ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর কিছু নির্দিষ্ট ক্রেতা তাঁদের কাছ থেকে গরু নিয়ে যান। পাশাপাশি ফেসবুকে দেখেও অনেকে গরু কিনেছেন। সব মিলিয়ে এবারও ভালো বিক্রি হয়েছে।
অনলাইনে সক্রিয় থাকার সুফল কেমন, তা বোঝা যাবে সিটি অ্যাগ্রোর কর্ণধার এনামুল হকের বর্ণনায়। এবার ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন জাতের ১৩০টি গরু প্রস্তুত করেছিলেন তিনি। ইতিমধ্যে ১১০টি গরু বিক্রি হয়েছে। সব কটি গরুর ছবি, ভিডিও পোস্ট করেছেন ফেসবুকে।
খামারে এবার ১ লাখ ৭৭ হাজার গবাদিপশু
জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের হিসাবে, চট্টগ্রামে এ বছর ১৪ হাজার ৭৮৬টি খামারে গবাদিপশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি খামার সাতকানিয়া উপজেলায়—২ হাজার ৪২টি। আর সবচেয়ে কম সন্দ্বীপে—১৫৬টি। এসব খামার থেকে গরু, ছাগল, ভেড়া, ষাঁড় মিলিয়ে মোট ১ লাখ ৭৭ হাজার ৪৩২টি গবাদিপশু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
বোয়ালখালীর শাহ মাজেদিয়া অ্যাগ্রোতে এ বছর ৮৭টি গরু ছিল। সবচেয়ে বড় গরু সুলতান, ওজনে প্রায় ২০ মণ। সুলতান বিক্রি হয়েছে ১১ লাখ টাকায়। খামারের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ইমতিয়াজ দাবি করেছেন, সার্বিকভাবে গরুর দাম ভারসাম্যপূর্ণ জায়গায় রয়েছে। কেননা পশুর খাবারের দাম গত বছরের তুলনায় কমেছে। যেমন গত বছর কোরবানির ঈদের আগে ৩৫ কেজি পাতা ভুসির দাম পড়েছিল ২ হাজার ১০০ টাকা। এ বছর একই মানের ও পরিমাণের ভুসি কিনতে খরচ হয়েছে ১ হাজার ৭০০ টাকা। এভাবে আরও বিভিন্ন ধরনের খাবারের দাম কম ছিল।
গত বছরের তুলনায় এবার খামারে গবাদিপশুর দাম ৫ থেকে ৬ শতাংশ বেশি বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলমগীর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনলাইনে দেখে গবাদিপশু কেনাকাটা এখন বেশ জনপ্রিয়। অনেকে হাটের ঝামেলা এড়াতে আগেভাগেই খামার থেকে গরু কিনে রাখছেন। কেনা গরু খামারেই রাখা যায়। অবশ্য খামারে গরুর দামে ভারসাম্য থাকলেও গতবারের চেয়ে কিছুটা বেশি।