দিয়োগো জোতা (৪ ডিসেম্বর ১৯৯৬–৩ জুলাই ২০২৫)ছবি: এক্স

প্রিয় জোতা, এভাবে চলে যেতে নেই

প্রিয় জোতা,

খুব তাড়াতাড়িই কি সবকিছু হয়ে যাচ্ছিল না! প্রিমিয়ার লিগ জেতা, উয়েফা নেশনস লিগ জেতা কিংবা শৈশবের প্রেমিকার সঙ্গে বিয়ে। কোথাও যাওয়ার যেন খুব তাড়া ছিল তোমার। ফুটবলার কিংবা মানুষ হিসেবে মোটেই অস্থির স্বভাবের ছিলে না। শান্ত ও ঠান্ডা মেজাজের তোমাকে মাঠে নেমেও কখনো তাড়াহুড়া করতে দেখা যায়নি।

চোট ভুগিয়েছে, প্রতিভা ও যোগ্যতা থাকার পরও দিনের পর দিন বেঞ্চে কাটাতে হয়েছে। র কারণে জাতীয় দলেও বেঞ্চকে করে নিতে হয়েছিল সঙ্গী। কিন্তু কোনো কিছুই লক্ষ্যচ্যুত করতে পারেনি তোমাকে। শান্ত ও স্নিগ্ধ যে হৃদয় তোমাকে গড়ে দিয়েছিল পোর্তোর মাসারেলস (জন্মশহর), সেটা কখনোই তুমি হারিয়ে যেতে দাওনি। যেন কোনো এক সন্তের কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে এসেছিলে। ফলে ফুটবল মাঠের বাইরে কোনো উত্তেজনাতেই ভাঙেনি সেই ধ্যান।

কিন্তু কে জানত, সেই তুমি ! বিল শ্যাঙ্কলির জীবন–মরণের ঊর্ধ্বে থাকা ফুটবলীয় দার্শনিক ভাবনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পাড়ি জমাবে অন্য লোকে।

পোর্তোর ছোট শহর মাসারেলসের ধুলো-বালিমাখা রাস্তা থেকে তোমার উত্থান। সেই ধুলোকে কখনো ঝরে যেতে দাওনি শরীর থেকে। কখনো বদলাওনি নিজের আত্মাকে।
ছোটবেলায় নাকি ছোট একটা পাতার আড়ালেও সহজে লুকিয়ে রাখতে পারতে নিজেকে। দেখতে ছোটখাটো বলেই সবাই ডাকত ‘দ্য স্মল গাই’ বলে।

কিন্তু হায়, তুমি আর কখনো সেই ডাকে সাড়া দেবে না। আর কখনো বেঞ্চে বসে মাঠে নামার অপেক্ষায় থাকবে না তুমি। অপেক্ষার সব দরজায় আজ এক অদৃশ্য তালা লেগে গেল জোতা৷ বড্ড অবেলায় যে চলে গেলে। এভাবে কেউ যায়, বলো, এত তাড়াহুড়া করে!

দেখ জোতা, তোমার জন্য অসংখ্য মানুষের বেদনার্ত হৃদয় আজ ভাষাহীন, বিমূঢ়। দেখ, তোমার চলে যাওয়ার খবর আসতেই অ্যানফিল্ডে কীভাবে জমা হতে শুরু করেছে ভালোবাসার ফুলগুলো। যে ফুটবলের ভাষা মানুষকে একটি ছাউনিতে একত্র করেছিল, তোমাকে হারিয়ে আজ সবাই যেন নিঃস্ব। তুমি আরেকবার মনে করিয়ে দিলে, সব চাওয়া–পাওয়ার ঊর্ধ্বে মৃত্যুই শুধু অমোঘ, চিরসত্য। এর বাইরে বাকি সবকিছু বড্ড ঠুনকো, অস্থায়ী।

তবু এই নশ্বর পৃথিবীতে অবিনশ্বর হওয়ার স্বপ্ন তুমি দেখেছিলে। তোমার সেই স্বপ্ন ছিল ফুটবল ঘিরে। এই গোলাকার বস্তুটাকে দিয়েই তুমি চেয়েছিলে নিজেকে বয়ে নিয়ে যেতে। উচ্চাশা কিংবা উচ্চাকাঙ্ক্ষা কখনো এসে ভিড় জমায়নি তোমার আঙিনায়। সেই আঙিনায় তুমি শুধু ফুটবল পায়ে খেলে যেতে চেয়েছিলে।

এটা জিতব, সেটা জিতব তেমন কোনো স্বপ্ন নয়, স্বপ্নটা ছিল শুধুই খেলে যাওয়ার। নিজেকে স্রেফ বয়ে নিয়ে যাওয়ার। সেই স্বপ্নই তোমাকে একদিন নিয়ে আসে উলভসে। উলভসে আসার পর নিজের স্বপ্নকে আরেকটু বিস্তৃত করেছিলে। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলে বড় কিছু অর্জনের। জীবন নিয়ে তোমার দার্শনিক ভাবনাটাই যে ছিল এমন।

চেষ্টা করেছিলে স্বপ্ন দিয়ে সব সময়ের স্বপ্নের দরজা খোলার। একটা স্বপ্ন দিয়ে আরেকটা স্বপ্নের পথকে উন্মুক্ত করার। সেই পথই একদিন তোমাকে নিয়ে এসেছিল লিভারপুলে; ফুটবল যাদের কাছে কখনো কখনো জীবন–মরণ সমস্যার চেয়ে বেশি কিছু।

লিভারপুলে এসে পেয়েছিলে ইয়ুর্গেন ক্লপের ভালোবাসা। ইশ্‌, আবেগপ্রবণ ক্লপ তোমার মৃত্যুর খবরে কীভাবে আজ ভেঙে পড়েছেন দেখেছ? কত বিপদে যে ক্লপের ভরসা হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়েছিলে! কোপাইটরা তোমাকে অনেক ভালোবেসেছিল, প্রিয় জোতা। কিংবদন্তি লুইস ফিগোর ওপরে তোমাকে জায়গা দিয়ে বেঁধেছিল গানও। তুমি নিজেও কি কখনো গুনগুন করে গাইতে না সেই গান, ‘হি ইজ ল্যাড ফ্রম পর্তুগাল/ বেটার দ্যান ফিগো, ডোন্ট ইউ নো/ ওহ হিজ নেম ইজ দিয়োগো।’

এই ভালোবাসা তোমার প্রাপ্য ছিল জোতা। এই ভালোবাসা তুমি আদায় করে নিয়েছিলে। ক্যারিয়ারজুড়ে চোট নিয়েও লড়ে গিয়েছিলে। তবু কখনো হাল ছাড়নি। লিভারপুলকে উদ্ধার করেছ অসংখ্যবার। এমনও হয়েছিল, যখন আর কোনোভাবে গোল পাওয়ার সুযোগ ছিল না, তখনই মাঠে নেমে উদ্ধার করেছ দলকে।

কিন্তু এখন আর কেউ নেই জোতা, যার ওপর আমরা বিশ্বাস রাখব। এমন কেউ নেই যে ৮০ মিনিটের পর গোল করে ম্যাচ জিতিয়ে দেবে। প্রিয় ‘স্মল গাই’ সত্যিই আর কেউ নেই!

আর কটা দিন পর নতুন মৌসুম শুরু হবে। এক বছরের কম সময়ের মধ্যে বিশ্বকাপ। এসব ভুলে অন্য লোকে কীভাবে সময় কাটবে তোমার! বিশ্বকাপেইবা কার ওপর আস্থা রেখে রোনালদো বিরতির পর মাঠ ছাড়বে বলো! গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গোল করার সেই লোকটাকে পর্তুগাল আর লিভারপুল কোথায় খুঁজবে বলো!

তুমি নেই জোতা, তবু ফুটবল থেমে থাকবে না। কদিন পরে তোমার চলে যাওয়ার শোকও মিলিয়ে আসবে। কিন্তু ফুটবলকে যারা শুধু ফুটবলের জন্য ভালোবেসেছে, তাদের হৃদয়ের কোণে অম্লান রয়ে যাবে তুমি। আমাদের ‘বেটার দ্যান ফিগো’, আমাদের ‘ইনজুরি টাইম স্কোরার’।

জোতা, তোমাকে কখনো চিঠি লিখতাম কি না জানি না। কিন্তু বিশ্বাস করো, ‘ছিল’ ব্যবহার করে এই চিঠি আমি কখনো লিখতে চাইনি। এভাবে কখনো আমি আর লিখতেও চাই না। অন্য লোকে ভালো থেকো জোতা। সঙ্গী করে নিয়ে যাওয়া ভাই আন্দ্রেকে ভালোবাসা দিয়ো।

ইতি,

এক সাধারণ ফুটবলপ্রেমী।