ক্যারিয়ারের নতুন দিগন্ত অটোমোবাইল

ক্যারিয়ারের নতুন দিগন্ত অটোমোবাইল

বর্তমানের প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির অন্যতম শিল্প হচ্ছে অটোমোবাইল। আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা, বৈদ্যুতিক গাড়ির উদ্ভাবন, জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি এবং পরিবেশবান্ধব দূষণ নিয়ন্ত্রণ—সবকিছুতেই অটোমোবাইল প্রযুক্তির সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। ফলে বিশ্বজুড়ে বাড়ছে এই টেকনোলজির ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা। কিন্তু অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে—অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং আসলে কী? এ টেকনোলজির কাজ কী? এ বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনের পর শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ার কেমন হতে পারে? এ ছাড়া আরও অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়। সেসব নিয়েই আজকের আয়োজন—

প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষ যাতায়াত, পণ্য পরিবহন কিংবা ভ্রমণের জন্য যেসব যানবাহনের ওপর নির্ভর করেন, সেই বাহনের নকশা, কার্যকারিতা, শক্তি উৎপাদন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করেন যারা, তাদেরই বলা হয় অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার। এটি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটি বিশেষায়িত শাখা। যা যানবাহনের যন্ত্রাংশ তৈরি, সমস্যা নির্ণয়, রক্ষণাবেক্ষণ এবং উন্নত প্রযুক্তির সংযোজন নিয়ে কাজ করে।

গাড়ির কোথায় কী সমস্যা, কোন সমস্যা কীভাবে কাটাতে হবে, কোথায় কোন যন্ত্রাংশ পাল্টানো বা মেরামত করতে হবে, কোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে গাড়ি সচল করা হবে, কোন পদ্ধতি ব্যবহার করলে সহজেই সফলতা মিলবে ইত্যাদি বিষয়ে এ টেকনোলজিতে কাজ করা হয়।

যেসব বিষয় আলোচনা হয়

১. অভ্যন্তরীণ দহন ইঞ্জিন
> পেট্রোল ও ডিজেল ইঞ্জিনের গঠন ও কার্যপ্রণালি
> ইঞ্জিনের বিভিন্ন অংশ ও তাদের কাজ (যেমন- পিস্টন, সিলিন্ডার, ক্র্যাঙ্কশাফট)
> ইঞ্জিন সাইকেল।

২. গাড়ির কাঠামো ও ডিজাইন
> গাড়ির মূল ফ্রেম বা চ্যাসিস
> গাড়ির বাহ্যিক গঠন
> বিভিন্ন ধরনের গাড়ির ডিজাইন।

৩. গিয়ার ও পাওয়ার ট্রান্সমিশন সিস্টেম
> গিয়ারবক্স, ক্লাচ, ফ্লাইহুইল
> ড্রাইভ শ্যাফট ও ডিফারেনশিয়াল
> ম্যানুয়াল ও অটোমেটিক গিয়ার ব্যবস্থা।

৪. সাসপেনশন ও স্টিয়ারিং সিস্টেম
> গাড়ি চলার সময় ঝাঁকুনি নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
> স্টিয়ারিং গিয়ার, পাওয়ার স্টিয়ারিং সিস্টেম।

৫. ব্রেকিং সিস্টেম
> ডিস্ক ও ড্রাম ব্রেক
> হাইড্রলিক ব্রেক, এয়ার ব্রেক
> আধুনিক ব্রেকিং প্রযুক্তি।

৬. গাড়ির ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক সিস্টেম
> ব্যাটারি, অ্যালটারনেটর, স্টার্টার
> হেডলাইট, টার্ন সিগনাল, সেন্সর।

৭. জ্বালানি ব্যবস্থা ও নির্গমন নিয়ন্ত্রণ
> ফুয়েল ইনজেকশন সিস্টেম
> এক্সহস্ট সিস্টেম ও পরিবেশবান্ধব নির্গমন প্রযুক্তি।

৮. তাপগতিবিদ্যা ও তাপ স্থানান্তর
> ইঞ্জিনে তাপ ব্যবস্থাপনা
> কুলিং ও লুব্রিকেশন সিস্টেম
> হিট এক্সচেঞ্জার ও ফ্যান।

৯. যানবাহনের গতি ও স্থিতিশীলতা
> ব্রেকিং, ঘুরানো, স্থিতিশীলতা বিশ্লেষণ
> সাসপেনশন ও টায়ার কনফিগারেশন।

১০. কম্পিউটার সহায়তাযুক্ত ডিজাইন
> গাড়ির যন্ত্রাংশ ডিজাইন করার সফটওয়্যার
> ডিজিটাল সিমুলেশন ও মডেল তৈরি।

১১. বিকল্প জ্বালানি ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি
> ইলেকট্রিক গাড়ি ও হাইব্রিড গাড়ি
> হাইড্রোজেন ও সোলারচালিত যান
> জ্বালানির দক্ষতা ও টেকসই প্রযুক্তি।

১২. গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ও কর্মশালা শিক্ষা
> যানবাহনের ত্রুটি শনাক্ত ও মেরামত
> ওয়ার্কশপ প্র্যাকটিস ও হ্যান্ডস-অন ট্রেনিং।

অটোমোবাইল শিল্পে কাজের ক্ষেত্র এখন বেশ বিস্তৃত। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেভাবে ইঞ্জিনের ব্যবহার বাড়ছে; সে ক্ষেত্রে দক্ষ কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে আমাদের দেশে ২৫টিরও বেশি গাড়ি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যারা প্রতিনিয়ত বিদেশ থেকে গাড়ি আমদানি করছে এবং এই শিল্পকে সমৃদ্ধ হতে সাহায্য করছে। এ ছাড়া দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত মোটরযানের সংখ্যা ৫৭ লাখ ৫২ হাজার ছাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে চাহিদার তুলনায় অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারের সংখ্যা অনেক কম। তাই এ সেক্টরে কর্মসংস্থানের সুযোগ অনেক বেশি। এ পেশায় এসে নিজের ক্যারিয়ারকে উজ্জ্বল করতে পারেন।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। উৎপাদন, সার্ভিসিং, ট্রান্সপোর্ট ও প্রযুক্তি খাত—সবখানেই এ পেশার গুরুত্ব বাড়ছে। দেশের বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, এমনকি উপজেলা বা গুরুত্বপূর্ণ ছোট-বড় শহরগুলোতে অটোমোবাইলসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও এ টেকনোলজির চাকরি আছে। এ ছাড়া বিদেশেও ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগও রয়েছে।

সরকারি চাকরি
১. বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন
কাজ: বাস ও ট্রাকের রক্ষণাবেক্ষণ, ওয়ার্কশপ পরিচালনা

২. বাংলাদেশ রেলওয়ে
কাজ: রেলওয়ের ইঞ্জিন, কোচ এবং যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ

৩. বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস
কাজ: বিমানবন্দরের যন্ত্রচালিত যান ব্যবস্থাপনা

৪. বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী
কাজ: সামরিক যানবাহনের তদারকি, মেরামত ও ব্যবস্থাপনা

৫. সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর
কাজ: যানবাহন ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত দায়িত্ব

৬. বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড
কাজ: যন্ত্রচালিত যান ও যান্ত্রিক সরঞ্জাম ব্যবস্থাপনা

৭. পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনসমূহ
কাজ: পৌরসভার যানবাহন মেরামত ও ফিটনেস মেইনটেনেন্স

৮. বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড
কাজ: গাড়ি ও যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ

৯. বাংলাদেশ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ ও বন্দর কর্তৃপক্ষ
কাজ: ক্রেন, হেভি ভেহিকেল, লোডার পরিচালনা ও মেরামত

১০. বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড
কাজ: কোম্পানির গাড়িবহর পরিচালনা

১১. বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ
কাজ: শিল্প এলাকার গাড়ি পরিচালনা ও মেরামত

১২. বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স
কাজ: যানবাহনের ফিটনেস ও প্রস্তুতি নিশ্চিতে কাজ করা

বেসরকারি চাকরি
১. গাড়ি ও মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান
২. গাড়ির আমদানিকারক ও ডিলার প্রতিষ্ঠান
৩. বেসরকারি গাড়ি সার্ভিসিং ও ওয়ার্কশপ প্রতিষ্ঠান
৪. টায়ার, ব্যাটারি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ উৎপাদক প্রতিষ্ঠান
৫. রাইড শেয়ারিং ও ট্রান্সপোর্ট সার্ভিস কোম্পানি
৬. লজিস্টিকস ও কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানি
৭. প্রযুক্তি ও সফটওয়্যার কোম্পানি।

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতার মাধ্যমে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ আছে। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কারিগরি ট্রেনিং সেন্টারেও চাকরি করতে পারবেন। শুধু তাই নয়, নিজেও সার্ভিস সেন্টার বা ওয়ার্কশপ খুলে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগও রয়েছে। ভালো দক্ষতা, হাতেকলমে অভিজ্ঞতা এবং কমিউনিকেশন স্কিল থাকলে খুব সহজেই এ টেকনোলজি নিয়ে ভালো ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব।

যারা ছোটবেলা থেকেই গাড়ি, বাইক কিংবা যন্ত্রচালিত প্রযুক্তির প্রতি গভীর আগ্রহ রাখেন এবং গণিত, পদার্থবিজ্ঞান ও টেকনিক্যাল বিষয়গুলোতে আগ্রহী, তাদের জন্য অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং একটি আদর্শ বিষয়। পাশাপাশি যারা সৃজনশীল চিন্তাভাবনায় দক্ষ এবং পরিবেশবান্ধব, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যানবাহন নির্মাণে অবদান রাখতে আগ্রহী, সেসব শিক্ষার্থীর জন্য অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং উপযুক্ত মাধ্যম হতে পারে।

যদি অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার বা ডিপ্লোমা অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার হতে চান, তাহলে ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪ বছর মেয়াদি বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করতে হবে। ডিপ্লোমা ইন অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার পড়ার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট আছে। ডিপ্লোমা শেষে সরকারিভাবে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট) বিএসসি করার সুযোগ আছে। এ ছাড়া দেশের অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বিএসসি করা যাবে।