সন্তানকে সব জায়গায় সেরা দেখতে চান পিকক প্যারেন্টসমডেল: সাদমান, প্রাজ্ঞ ও অদিতি। ছবি সুমন ইউসুফ

আপনি কি পিকক প্যারেন্ট? মিলিয়ে নিন বৈশিষ্ট্যগুলো

সন্তান লালন–পালনের নানান ধারার কথা শোনা যায় আজকাল, তবে সব ধারাই শিশুর জন্য ইতিবাচক নয়। ‘পিকক প্যারেন্টিং’ এমন একটি ধারা। নিজের অজান্তেই হয়তো এই ধারার চর্চা করে সন্তানের ব্যক্তিত্বের বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন আপনি। কারা পিকক প্যারেন্ট, কী তাঁদের বৈশিষ্ট্য, আর কীভাবেই–বা এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসা যায়, শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যার সহকারী অধ্যাপক ও যুক্তরাজ্যের সিনিয়র ক্লিনিক্যাল ফেলো ডা. টুম্পা ইন্দ্রানী ঘোষের কাছ থেকে জেনে নেওয়া যাক।

নার্সিসিস্ট বা আত্মপ্রেমী একজন মানুষ যখন সন্তান লালন–পালন করেন, তখন তিনিই হয়ে ওঠেন পিকক প্যারেন্ট। সন্তানকে সব জায়গায় সেরা দেখতে চান তিনি। সন্তান লালন–পালনের বিষয়ে নিজের ধারণার বাইরে যেতে চান না। অন্য কারও পরামর্শ গ্রহণ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে নিজেকেই গুরুত্ব দেন সবচেয়ে বেশি। ভাবেন, তিনিই সেরা। সন্তান লালন–পালনেও সেই ভাবনারই প্রতিফলন ঘটে। বুঝতেই পারছেন, নিজেকে জাহির করার প্রবণতা থাকে তাঁর মধ্যে। নিজের শ্রেষ্ঠত্বের জন্য অন্যের কাছ থেকে প্রশংসা পেতে চান। অন্যের আবেগের গুরুত্ব খুব একটা থাকে না এ ধরনের মানুষের কাছে। অভিভাবক হিসেবে সন্তানের আবেগের চেয়ে সন্তানকে ‘সেরা’ হিসেবে দেখার প্রতিই জোর দেন তিনি। সাফল্যের জন্য অকারণ চাপ সৃষ্টি করেন তার ওপর। সন্তানকে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টাও করেন। সন্তানের সঙ্গে অন্য কারও সুসম্পর্ক দেখলে তাঁর হিংসাও হতে পারে।

সবেতেই ‘সেরা’ হওয়ার প্রত্যাশা পূরণ করা কঠিন। ফলে পিকক প্যারেন্টের সন্তান মানসিকভাবে বেশ চাপে থাকে। অত্যধিক চাপের কারণে হাসি-আনন্দমাখা ঝলমলে শৈশব থেকে সে বঞ্চিত হতে পারে। নিজের সাফল্যের বিষয়ে উদ্বেগ কাজ করতে পারে এমন সন্তানদের মধ্যে। অভিভাবকের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারলে হীনম্মন্যতায় ভুগতে পারে সে। সন্তানের ব্যক্তিত্ব বিকাশের ওপরও পিকক প্যারেন্টিংয়ের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকতে পারে তার ভাবনার জগৎ। তাই বড় হতে হতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। এমনকি জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য থেকেই বঞ্চিত হতে পারে একজন পিকক প্যারেন্টের সন্তান।

যদি আপনার সঙ্গীর মধ্যে পিকক প্যারেন্টের বৈশিষ্ট্য থাকে, তাহলে আপনার দায়িত্ব কিন্তু অনেক। একদিকে সঙ্গীকে সাবধানে ধরিয়ে দিতে হবে সন্তান লালন–পালনে তাঁর ভুলগুলো, অন্যদিকে আবার সন্তানের বিকাশ নিশ্চিত করতে তার কোমল মনের বাড়তি যত্নও নিতে হবে, কমাতে হবে তার মনের চাপ। তার ভাবনার জগৎটাকে বিস্তৃত করে দিতে হবে। তার মনের জানালাগুলো আপনাকেই খুলে দিতে হবে।

সঙ্গীকে ভুল ধরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি খুবই সংবেদনশীল। দোষারোপ করা যাবে না; বরং সন্তানের প্রতি তাঁর কোনো আচরণের বিষয়ে উল্লেখ করতে হবে সহজ ও সুন্দর করে। সরাসরি কোনো নেতিবাচক বিষয়ের উল্লেখ না করে একটু ঘুরিয়ে গ্রহণযোগ্য উপায়ে আপনার মনের ভাব প্রকাশ করুন। বিষয়টি নিয়ে ঝগড়া নয়, আলোচনা করুন। এমনটা বলবেন না, ‘কথাটা তুমি ওকে এভাবে বলেছো কেন?’ বরং বলতে পারেন, ‘তুমি কথাটা এভাবে না বলে ওভাবে বললে কি আরেকটু ভালো হতো না?’ সঙ্গীকে যে কথাই বলুন, কণ্ঠে যেন কোমলতা থাকে, থাকে ভালোবাসার উষ্ণতা। কখনোই যেন এমনটা মনে না হয় যে আপনি তাঁর চিন্তাধারার অবমূল্যায়ন করছেন। তাঁর ভাবনায় সমমর্মী হোন। তাঁর আচরণে শিশুর ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে, সুন্দরভাবে তা বোঝাতে চেষ্টা করুন। এসব আলোচনা সন্তানের সামনে করা যাবে না, সে কথাও মাথায় রাখুন।

আপনার মধ্যেই যদি পিকক প্যারেন্টের বৈশিষ্ট্য খুঁজে পান, তাহলে কী করবেন? একটু একটু করে নিজের এই বৈশিষ্ট্য বদলাতে চেষ্টা করুন। আপনি অবশ্যই সন্তানের ভালোর জন্য সবকিছু করছেন। আপনার চাওয়ার মধ্যে কোনো ভুল নেই। তবে আপনার প্রত্যাশার চাপে সন্তান যেন ভেঙে না পড়ে, সেদিকেও খেয়াল রাখুন। মনে রাখবেন, সবেতেই ‘সেরা’ হওয়ার চেয়ে মানবিকতার চর্চা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জীবনে অন্যের প্রশংসার চেয়ে নিজের প্রশান্তি বড়। আপনি নিশ্চয়ই হাসিখুশি আর সুখী সন্তানের অভিভাবক হতে চান। সেই ভাবনা মাথায় রেখে এগোলে তার জীবনটাকে সহজ করে তোলার চেষ্টা করাই হবে আপনার দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যদি প্রয়োজন হয়, নিজের জন্য মনোবিদের সহায়তা নিন। এ–ও মনে রাখবেন, আপনার এই বৈশিষ্ট্য কিন্তু কোনো রোগ নয়। কেবল নিজের সন্তানের জীবনকে চমৎকার করে তুলতেই নিজেকে একটু বদলাতে হবে। আর সেই পরিবর্তনের পথে একজন বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিলে আপনার কাজ সহজ হয়ে উঠবে।