ইতিহাস কখনো নিছক অতীত নয়। সময়ের নিরবধি স্রোতে কিছু ক্ষণ এমন আসে যা যুগজয়ী হয়ে ওঠে—ঘটনা নয়, চেতনার আখ্যান হয়ে যায়।
কারবালা তেমনই এক অধ্যায়, আর গাজা সেই অধ্যায়ের চলমান পৃষ্ঠা। একদিকে সপ্তম শতকের মরুপথে রক্তস্নাত আত্মত্যাগ, অন্যদিকে আধুনিক যুগের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে এক অবিরাম আত্মমর্যাদার লড়াই।
সময়ের ব্যবধান যতই হোক, অন্তরের ধ্বনি এক। হুসাইন যখন বলেছিলেন, ‘অবিচারের কাছে মাথা নত করব না’, তখন তা শুধু কুফার প্রান্তরের উচ্চারণ ছিল না, তা ছিল এক ভবিষ্যদ্বাণী, যা গাজার ধ্বংসস্তূপেও প্রতিধ্বনি তুলেছে।
এক নজরে কারবালা: ইতিহাসের বুকে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা
৬১ হিজরি, ১০ মহররম, ইরাকের কারবালা। উমাইয়া খেলাফতের শাসক ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য স্বীকারে অস্বীকৃতি জানান নবীজির দৌহিত্র ইমাম হুসাইন। অন্যায়ের হাতে ইসলামকে সমর্পণ না করে, পরিবারসহ রওনা হন কুফার উদ্দেশে। পথেই তাকে অবরুদ্ধ করে ইয়াজিদের বাহিনী।
অতঃপর নীরব মরুভূমিতে রক্তে লেখা হয় ইতিহাস, ৭২ জন শহীদের আত্মত্যাগ রচনা করে সত্য ও অন্যায়ের সংঘর্ষের চিরন্তন প্রতীক।
এই সংঘর্ষ কেবল রাজনৈতিক নয়; বরং নৈতিক, আদর্শিক ও ধর্মীয় চেতনার এক অমোঘ কণ্ঠস্বর। হুসাইন তার জীবন দিয়ে প্রমাণ করেন, সংখ্যার বিজয় নয়—মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠাই চূড়ান্ত সফলতা।
গাজা: সমকালীন বিশ্বে এক নিরব কারবালা
প্রায় চৌদ্দশ বছর পর, ভূমধ্যসাগরের উপকূলে, পবিত্র ভূমি ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় চলছে অন্য এক কারবালা।
১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুতি শুরু হয়। এরপর ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে গাজা, পশ্চিম তীরসহ বৃহৎ এলাকা দখল করে নেয় ইহুদি রাষ্ট্র।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাজার জনপদ পরিণত হয় এক খোলা কারাগারে—বাইরের দিকে অবরুদ্ধ, ভেতরে ধ্বংসের আতঙ্ক।
বছরের পর বছর ধরে চলা দখল, অবরোধ এবং অস্ত্রসজ্জিত আগ্রাসনের মাঝেও গাজার মানুষ মাথা নত করেনি। শহীদ, আহত, নিঃস্ব—তবুও অবিচল। এই গাজাই আজ মানবতা ও প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এখানে প্রতিটি ধ্বংসস্তূপ, প্রতিটি রক্তাক্ত শিশুর মুখ যেন পুনর্জাগরিত করে কারবালার প্রতিচ্ছবি।
চেতনার সেতু: হুসাইন ও গাজার প্রতিরোধ
কারবালায় হুসাইনের সংগ্রাম ছিল আত্মমর্যাদার জন্য, সত্য ও ইসলামী নেতৃত্বের পবিত্রতা রক্ষার্থে। গাজার প্রতিরোধও একই চেতনায় উজ্জ্বল। তারা জানে, বিজয় মানে শুধু ট্যাঙ্ক বা যুদ্ধবিমান নয়; বরং বিজয় মানে অন্তরে অবিচল বিশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া—যা কারবালায় শিখিয়েছেন ইমাম হুসাইন।
কারবালায় একটি শিশু—আলি আসগর—জল চেয়েছিল। গাজায় শিশুদেরও চাহিদা বিশুদ্ধ পানি, নিরাপদ ঘর, মায়ের কোলে একটু নিদ্রা। তবুও প্রতিদিন তাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় তাকবির, তাদের চোখে দেখা যায় প্রতিরোধের দীপ্তি।
গাজা উপত্যকা প্রায় ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার—এক ক্ষুদ্র ভূখণ্ড, যেখানে বসবাস করছে প্রায় ২২ লক্ষ মানুষ। এটি বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল।
ইসরাইল ২০০৭ সাল থেকে গাজাকে পুরোপুরি অবরুদ্ধ রেখেছে—স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে। বিদ্যুৎ, ওষুধ, খাদ্য, জ্বালানি—সব কিছুই নিষিদ্ধ কিংবা নিয়ন্ত্রিত।
২০১৪ সালের ‘অপারেশন প্রটেকটিভ এজ’-এ ২,২৫১ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে ৫৫৬ জন শিশু। ২০২১ সালের মে মাসে ১১ দিনের হামলায় নিহত হন আরও শতাধিক শিশু।
২০২৩- থেকে চলমান সর্বশেষ গণহত্যায় বিশ্বের সামনে নগ্ন হয়ে পড়ে ইসরাইলি দমননীতির নিষ্ঠুর চেহারা।
এই পরিসংখ্যান শুধুই সংখ্যা নয়, প্রতিটি শহীদ এক একটি চেতনার শিখা, যা হুসাইনের উত্তরাধিকার বহন করে।
উম্মাহর প্রতিক্রিয়া ও নিষ্ক্রিয়তা: ইয়াজিদি চেতনার পুনর্জাগরণ?
কারবালার সময় কুফার মানুষ প্রতিশ্রুতি দিয়েও পাশে দাঁড়ায়নি। একইভাবে আজ ফিলিস্তিনের পাশে দাঁড়াতে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো দ্বিধাগ্রস্ত। কেউ অর্থনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করে, কেউ কৌশলী নিরবতা অবলম্বন করে। এই নিরবতা কি তবে ইয়াজিদি চেতনার আধুনিক রূপ নয়?
গাজার জন্য জেগে উঠে একদল মানুষ—তরুণ, শিশু, মা। তাদের হাতে নেই পরমাণু অস্ত্র, নেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আসন। কিন্তু আছে অন্তরজাগরিত ঈমান, আছে শহীদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। যারা জীবনের পরিবর্তে শহীদি মর্যাদা চায়, তাদের দমন করা যায় না।
প্রতিরোধের ভাষা: কলম, ক্যামেরা ও কোরবানি
গাজার মানুষ যুদ্ধ করে শুধু অস্ত্র দিয়ে নয়। তারা লড়ে সাংবাদিকতায়, কবিতায়, চিত্রকর্মে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, এমনকি এক টুকরো রুটি আর একটি গাছের ছায়ার নিচে দাঁড়িয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে।
শিশুদের স্কুলভবন ধ্বংস হয়, তারা খোলা আকাশের নিচে ক্লাস নেয়। কন্যাশিশু রাহাফ বা হানাদি যখন নিজের ভাইয়ের শহীদ হওয়ার ভিডিও ধরে কাঁদে না—তখন তা এক নতুন প্রতিরোধ হয়ে দাঁড়ায়।
কারবালায় জয়নাব ছিলেন হুসাইনের বোন, কিন্তু প্রতিরোধের ভাষ্যকারও। গাজার প্রতিটি মেয়ে, প্রতিটি মা যেন সেই জয়নাবের আত্মা ধারণ করে আছেন। তারা কাঁদেন না, প্রতিজ্ঞা করেন: “আমার সন্তান শহীদ হয়েছে, আমি আরও সন্তান জন্ম দেব এই পথেই।”
ইসলামি চেতনার জাগরণ ও কারবালার পুনরাবৃত্তি
কারবালা শুধুমাত্র ইতিহাসের এক রক্তাক্ত ক্ষণ নয়, এটি মুসলিম উম্মাহর আত্মপরিচয়ের কেন্দ্র। হিজরি বর্ষপঞ্জি শুরুই হয় হিজরতের স্মৃতি দিয়ে; আর মহররম তার চূড়ান্ত রক্তদানের ঘোষণা দেয়। এই বার্তা বারবার ফিরে আসে গাজার বুক চিরে।
মাটির নিচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে, ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে, ফাতিহা পাঠ করতে করতে গাজার মুসলমানরা জানান দেন: “আমরা হুসাইনের উত্তরসূরি, আমরা ত্যাগে ভয় পাই না।”
সত্য ও মিথ্যার সংঘর্ষ: ইতিহাসের চিরন্তন সূত্র
ইতিহাসের যে সূত্র বারবার সত্য হয়ে ধরা দেয়—তা হলো, অত্যাচার দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ফেরাউন ডুবেছে, নমরূদ নিঃশেষ হয়েছে, ইয়াজিদের নাম ইতিহাস ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারণ করে। কিন্তু হুসাইন, মূসা, ইব্রাহিম—এই নামগুলো যুগ যুগ ধরে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।
গাজা হেরে যাবে—এই কথা বলে যারা ঘুমায়, তারা জানে না আত্মমর্যাদা কখনো হারে না। প্রতিরোধী জাতি কখনো পরাজিত হয় না; তাদের বিজয় কেবল সময়ের অপেক্ষা। তারা ইতিহাসের গর্ভে বপন করে সেই বীজ, যা একদিন নতুন সূর্য হয়ে উদিত হয়।
কারবালার চেতনার রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা
কারবালা আমাদের শিখিয়েছে—রাজনীতি যদি নৈতিকতাবিহীন হয়, তা শয়তানের সেবক হয়ে ওঠে। ইয়াজিদের রাজনীতি ছিল ইসলামকে ঢাল বানিয়ে স্বৈরশাসন কায়েম করার। গাজার ক্ষেত্রেও দেখা যায়, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কিভাবে মানবাধিকারের মুখোশ পরে গণহত্যার অনুমোদন দেয়। পশ্চিমা বিশ্বের তথাকথিত সভ্যতা গাজার কান্না দেখে না, কিন্তু একটি ক্ষুদ্র হামলায় নিন্দার ঝড় তোলে। এই দ্বৈতনীতি আজকের ইয়াজিদি মুখোশ।
পরিশেষ নয়, প্রতিজ্ঞা
এই লেখা কোনো উপসংহার চায় না, কারণ গাজার কান্না থামেনি, কারবালার রক্ত শুকায়নি। এ এক চলমান ইতিহাস, যার প্রতিটি শব্দ জেগে ওঠে নতুন করে।
এ প্রবন্ধ কেবল তথ্যের সংকলন নয়, বরং এক চেতনার শপথ—হুসাইন যেমন অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি, তেমনি গাজার প্রতিটি শিশু, মা, কিশোর, বৃদ্ধ ও তরুণ সেই চেতনা আঁকড়ে ধরে বলছে:
আমরা রক্ত দেব, কিন্তু আমাদের জমিন, ধর্ম ও মর্যাদা বিক্রি করব না।
আমরা মরব, কিন্তু আত্মসমর্পণ করব না।
আমরা গাজা, আমরা কারবালা।
আমরা হুসাইনের উত্তরসূরি।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামিক থিওলজি বিভাগ, আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর