অটিজমের জেনেটিক রহস্য: কেন কিছু মানুষ আক্রান্ত হয়

অটিজমের জেনেটিক রহস্য: কেন কিছু মানুষ আক্রান্ত হয়

শিশুদের স্নায়ুগত বা মস্তিষ্কের বিকাশজনিত একটি জটিল সমস্যা ‘অটিজম’। অটিজমের বিকাশে জেনেটিক কারণগুলোর বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়; তবে এ নিয়ে দশকের পর দশক ধরে রহস্য থেকে গেছে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা অটিজমের পেছনে কিছু যোগসূত্র আবিষ্কার করতে শুরু করেছেন।

১৯৭০’র দশক পর্যন্ত মনোবিজ্ঞানে প্রচলিত বিশ্বাস ছিল, অটিজম খারাপ অভিভাবকত্বের ফল। ১৯৪০’র দশকে অস্ট্রিয়ান মনোরোগ বিশেষজ্ঞ লিও কানার ‘রেফ্রিজারেটর মাদার’ নামে একটি বিতর্কিত তত্ত্ব দেন। এতে তিনি বলেন, অটিজম শিশুদের প্রাথমিক জীবনের ট্রমার কারণে হয়। এর পেছনে সেসব মায়েরা দায়ী- যারা ঠান্ডা স্বভাবের, অযত্নশীল এবং সন্তানদের দূরে ঠেলে রাখেন।

ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির (ইউসিএলএ) স্নায়ুবিজ্ঞান ও জেনেটিক্সের অধ্যাপক ড্যানিয়েল গেশউইন্ড বলেন, এখন এই তত্ত্বকে সম্পূর্ণ ভুল ও ক্ষতিকর হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে; কিন্তু এই তত্ত্ব ভুল প্রমাণ করতে তিন দশক লেগে যায়।

অটিজম প্রায়ই অভিন্ন যমজদের (যাদের চেহারা ও গঠনে ৯০ শতাংশ মিল থাকে) মধ্যে দেখা যায়। এর ফলে অটিজমের উত্স সম্পর্কে আরও সূক্ষ্ম এবং বাস্তবসম্মত ধারণা গড়ে ওঠে।

১৯৭৭ সালে এক যুগান্তকারী গবেষণায় প্রমাণ হয় যে, অটিজম প্রায়ই অভিন্ন যমজদের মধ্যে দেখা যায়। আর তখন থেকেই অটিজমের উৎপত্তি নিয়ে আরও নিখুঁত ও বাস্তবসম্মত ধারণা গড়ে ওঠে।

১৯৭৭ সালের এই গবেষণাতেই প্রথমবারের মতো অটিজমের সঙ্গে জেনেটিক সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়। গবেষণায় দেখা যায়, যদি জমজ সন্তানের একজনের অটিজম থাকে, তাহলে অন্য সন্তানের মধ্যেও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশের বেশি। ফ্র্যাটার্নাল যমজদের (চেহারা ও গঠনে ৫০ শতাংশ মিল থাকে, মায়ের পেটে একই সময় থাকলেও তাদের লিঙ্গ, ত্বক, চোখ, চুলের রঙে ভিন্নতা থাকতে পারে) ক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা প্রায় ৩৪%। এই হিসেবে সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অটিজমের হার তুলনামূলক কম; শতাংশের হিসেবে এটি ২.৮।

বর্তমানে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত যে, অটিজমের পেছনে শক্তিশালী জেনেটিক উপাদান কাজ করে। কিন্তু কোন কোন জিন জড়িত এবং অটিজমের প্রকাশ কীভাবে অন্যান্য উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়— এই রহস্যের জট এখন খুলতে শুরু করেছে।

ক্ষুদ্র পার্থক্য, বড় প্রভাব

১৯৭৭ সালের গবেষণার পরও মানব জিনোম ও অটিজমের মধ্যকার সম্পর্কের জটিলতা সম্পূর্ণভাবে অনুধাবন করতে কয়েক দশক লেগে যায়।

মানুষের মধ্যে জেনেটিক ভিন্নতার পরিমাণ খুব সামান্য — মাত্র ০.১%। অর্থাৎ প্রতি ১০০০টি ডিএনএ বেসের মধ্যে গড়ে একটি পার্থক্য থাকে।

প্যারিসের ইনস্টিটিউট পাস্তুরের নিউরোসায়েন্স অধ্যাপক থমাস বুর্জরঁ বলেন, ‘এই পার্থক্য কখনো কোনো প্রভাব ফেলে না, কখনো সামান্য ফেলে, আবার কখনো তা অত্যন্ত শক্তিশালী প্রভাব সৃষ্টি করে।’

বর্তমানে প্রায় ২০% অটিজমের ক্ষেত্রে এমন ‘শক্তিশালী’ জেনেটিক ভিন্নতা শনাক্ত হয়েছে, যেখানে একটি মাত্র জিনের ‘একটি’ মিউটেশনই (কোষের জিনগত পরিবর্তন) মস্তিষ্কের বিকাশে বড়সড় পরিবর্তন ঘটায়। এই একক জিন মিউটেশন ও তার উৎপত্তি নিয়ে অটিজমের গবেষণা বর্তমানের অন্যতম গুরুত্বপূ্র্ণ ক্ষেত্র। কেননা এটি তীব্র ও জীবনব্যাপী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

বুর্জরঁ বলেন, ‘এটি সিনেমায় দেখা অটিজমের মতো নয়। আপনি যদি এই ধরনের মিউটেশন নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেন তাহলে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতা, চলাফেরার স্থুলতা কিংবা মৃগীরোগের সম্ভাবনা থাকে। এটি এ রোগে আক্রান্তদের জীবনমান এবং পরিবারের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।’

বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ১০০টি জিন শনাক্ত করেছেন যেগুলোতে এই ধরনের মিউটেশন দেখা যায়। ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো বুর্জরঁ আটিজমের সঙ্গে সম্পর্কিত দুটি দুটি জিনের মিউটেশন আবিষ্কার করেন। এই জিনগুলো সিন্যাপটোজেনেসিস বা স্নায়ুর সংযোগ গঠনের প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন তৈরি করে। যদিও এটি একটি বড় আবিষ্কার ছিল কিন্তু তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ইরাকে যুদ্ধ ঘোষণার কারণে তা তখন গণমাধ্যমে খুব একটা গুরুত্ব পায়নি।

এরপর আরও অনেকগুলো জিনের মিউটেশন আবিষ্কার হয়। এর মধ্যে একটি হলো ‘সাঙ্ক৩’ জিনের মিউটেশন। অটিজমে আক্রান্ত ১ শতাংশেরও কম ব্যক্তিদের মধ্যে এটি দেখা যায়। অনেক সময় এই মিউটেশন ‘ডি নোভো ভ্যারিয়েন্ট’ নামে পরিচিত; অর্থাৎ, এটি ভ্রূণ অবস্থায় হঠাৎ করেই ঘটে যায় এবং মায়ের বা বাবার ডিএনএ-তে তার কোনো চিহ্ন থাকে না।

কিন্তু কখনো কখনো এই ধরনের মিউটেশন পিতামাতার মধ্যেও থাকে। তবে তারা সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় পৃথিবীতে বাস করেন। এই বিষয়টি গবেষকদের কাছে গত এক দশক ধরে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।

‘আপনি হয়তো অবাক হতে পারেন- যদি শিশু তার পিতামাতার থেকে একটি বিরল জিন মিউটেশন পায়, তবে বাবা-মায়ের অটিজম কেন নেই?’ বলেন গেশউইন্ড।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘বাবা-মার ক্ষেত্রে এটি যথেষ্ট প্রভাব ফেলে না কিন্তু সন্তানের ক্ষেত্রে এই প্রধান মিউটেশন অন্য ছোট ছোট ভ্যারিয়েন্টের সঙ্গে মিলেমিশে নিউরোডেভেলপমেন্টে পরিবর্তন আনে।’

জেনেটিক বাফার

এতদিন গবেষকরা অটিজমকে একক জিন মিউটেশনের কারণে হওয়া একটি নির্দিষ্ট জেনেটিক সমস্যা বলে দেখেছেন; কিন্তু বর্তমানে তারা বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখছেন। অটিজম অনেকগুলো ছোট ছোট জেনেটিক ভ্যারিয়েন্ট এবং পরিবেশগত উপাদানের সম্মিলিত প্রভাবেও হতে পারে।

এই ধারণা অনুযায়ী, এমন কিছু লোক আছে যাদের ডিএনএ-তে একটি বিরল ও শক্তিশালী মিউটেশন থাকলেও তাদের অটিজম হয় না। কেননা, পাশাপাশি তারা শরীরে অন্য কিছু ‘প্রতিরোধী’ জিন বহন করেন, যেগুলো ক্ষতিকর প্রভাবকে প্রশমিত করে। এটিকে বলা হয় ‘জেনেটিক বাফারিং’।

গেশউইন্ড বলেন, ‘যদি কারো জিনে ঝুঁকিপূর্ণ মিউটেশন থাকে, তবুও তার নিউরোডেভেলপমেন্ট স্বাভাবিক থাকতে পারে। কারণ অন্যান্য জিনসমূহ সেই ঝুঁকিকে সামাল দেয়।’

এই কারণেই কিছু লোক অটিজমের জেনেটিক উপাদান বহন করলেও তারা নিউরোটিপিক্যাল বা স্বাভাবিক হতে পারেন। অন্যদিকে একই জিন থাকা সত্ত্বেও আরও কিছু অতিরিক্ত ক্ষতিকর ভ্যারিয়েন্ট কারো ক্ষেত্রে অটিজমকে উদ্দীপ্ত করে তুলতে পারে।

লিঙ্গ এবং অটিজম

অটিজমের বিকাশে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল– লিঙ্গ। অটিজমে আক্রান্ত পুরুষদের সংখ্যা নারীদের তুলনায় চার গুণ বেশি। কিন্তু কেন?

গবেষণা বলছে, নারীদের অটিজম হওয়ার জন্য পুরুষদের তুলনায় আরও বেশি জেনেটিক মিউটেশন দরকার পড়ে। অন্যভাবে বললে, নারীরা বেশি অটিজম ‘প্রতিরোধী’। তারা অনেক বেশি জেনেটিক পরিবর্তন সত্ত্বেও অটিজম থেকে সুরক্ষিত থাকতে পারে।

অধ্যাপক গেশউইন্ড বলেন, ‘কোনো না কোনোভাবে নারীরা স্নায়ুবিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে জন্ম নেয়। তাদের নিউরোডেভেলপমেন্টাল সিস্টেমে পরিবর্তন আনার জন্য আরও বড় ধাক্কা দরকার পড়ে।’

নারীদের এমন সক্ষমতার পাশাপাশি একটি উদ্বেগের বিষয়ও রয়েছে। নারীদের মধ্যে যখন অটিজম ধরা পড়ে তখন সাধারণত এটি পুরুষদের চেয়ে বেশি তীব্র এবং আরও জটিলভাবে প্রকাশ পায়।

পরিবেশগত প্রভাব

জেনেটিক ও লিঙ্গগত কারণ ছাড়াও অটিজমের পেছনে পরিবেশগত উপাদানগুলোরও ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অফ হেলথ (এনআইএইচ)-এর মতে, অটিজমের পেছনে সম্ভাব্য অ-জেনেটিক কারণের মধ্যে রয়েছে গর্ভাবস্থায় বায়ুদূষণ ও নির্দিষ্ট কীটনাশকের সংস্পর্শ, সময়ের আগে বাচ্চার জন্ম এবং প্রসবকালীন মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বর্তমানে জেনেটিক উপাদান শনাক্ত করার ফলে চিকিৎসায় উন্নতি আনার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

বুর্জরঁ বলেন, ‘ভবিষ্যতে হয়তো আমরা কোনো শিশুর জন্মের আগে (গর্ভে থাকার সময়) ডিএনএ বিশ্লেষণ করে তার অটিজম ঝুঁকি নির্ধারণ করতে পারবো। এই তথ্য ব্যবহার করে আগেভাগেই সহায়তা এবং থেরাপি শুরু করা যেতে পারে। ভবিষ্যতে নির্দিষ্ট ধরনের জিন লক্ষ্য করে চিকিৎসা পদ্ধতি তৈরি হতে পারে।’

তবে গেশউইন্ড সতর্ক করেন– শুধু জিন জানলেই সমস্যার সমাধান হয় না। অটিজমের প্রকাশ জিনের বাইরেও– পরিবেশ, জন্মের সময়ের জটিলতা এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য উপাদানের সাথে সম্পর্কিত।

তিনি বলেন, ‘আমরা যত বেশি আবিষ্কার করছি, ততই বুঝছি এটি কত জটিল একটি চিত্র!’