আক্ষেপ ঘোচানো যে ট্রফির দাম আসলে ২৮ হাজার কোটি টাকা
চোখ কপালে তুলে দেওয়া রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে নিয়ে আসা নেইমারকে দিয়ে হয়নি, এমবাপ্পেকে দিয়েও না। এই দুজনের সঙ্গে লিওনেল মেসিকে যোগ করেও কাজ হয়নি। প্রতিপক্ষের রক্ষণভাগে ভয়ের কাঁপন জাগানো এই ত্রিফলার জন্যও যা অসাধ্য হয়ে থেকেছে, সেটিই কিনা সাধন করে ফেলল তরুণ এক দল! যে দলে সেই অর্থে তারকা বলতে কেউ নেই। অথবা এমনও বলতে পারেন, যে দলে কেউই তারকা নন, আবার সবাই তারকা।
প্রথম একাদশের গড় বয়স ২৫-এর নিচে। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল এর চেয়ে তরুণতর দলকে মাঠে নামতে দেখেছে মাত্র একবারই। ২ গোল করে ফাইনালের নায়কের বয়স মাত্র ১৯। ম্যাচ যখন শেষ বাঁশির অপেক্ষায়, তখন শেষ গোল করা বদলি হিসেবে নামা তরুণেরও তা-ই। ইউরোপের সেরা ক্লাব দল—এটা তো চ্যাম্পিয়নস ট্রফির গায়েই খোদাই হয়ে গেছে। গতকাল রাতে মিউনিখের আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় উৎসবে মেতে ওঠা বর্তমানের সেরা এই দল কি সুবর্ণ ভবিষ্যতের একটা ঘোষণাও দিয়ে রাখেনি!
দলটির নাম যে প্যারিস সেন্ট জার্মেই, এটা আপনি জানেন বলেই অনুমান করি। হয়তো এটাও জানেন, মিউনিখের এই রাতের জন্য, মার্কিনিওসের হাতে ট্রফি ওঠার ওই মুহূর্তটির জন্য কত বছরের সাধনা, কত হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। শেষটা একেবারে নির্দিষ্টভাবে না-ও জানতে পারেন। তাহলে জানিয়ে দিই, ২০১১ সালে কাতারি স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপ প্যারিসের ক্লাবটিকে বিশ্বসেরা বানানোর মিশন নেওয়ার পর ১৪ বছরে খরচ করেছে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা!
এত মূল্য দিয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগের ট্রফি ‘কেনেনি’ আর কোনো দল। চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার অর্থ পুরস্কার অনেক। বিশ্বকাপ জিতলেও এত টাকা নেই। ২০২২ বিশ্বকাপ জিতে আর্জেন্টিনা যা পেয়েছিল, পিএসজি পাচ্ছে এর প্রায় তিন গুণ। কিন্তু পিএসজির চেয়ারম্যান নাসের আল খেলাইফিকে ওই ১৫০০ কোটি টাকা প্রাইজমানির কথা বললে তিনি তা হেসেই উড়িয়ে দেবেন। আরে, এটার জন্য আমরা লালায়িত নাকি, আমরা তো চেয়েছি ওই ট্রফিটা, শুধুই ওই ট্রফিটা। এতগুলো বছর শয়নে-স্বপনে-নিদ্রায়-জাগরণে যে ট্রফিটি দেখে এসেছেন খেলাইফি, সেই ট্রফি এখন প্যারিস সেন্ট জার্মেইয়ের ক্যাবিনেটে। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে খেলাইফি যে মার্কিনিওসকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকলেন, তা সেই স্বপ্ন পূরণের আনন্দে। মার্কিনিওস তো শুধু এই দলের অধিনায়কই নন, এক যুগ ধরে নীল জার্সি গায়ে খেলতে খেলতে হয়ে ওঠা প্যারিস সেন্ট জার্মেইয়ের প্রতীকও। ও হ্যাঁ, তরুণ এই দলের একমাত্র ‘বুড়ো’-ও। অথচ মার্কিনিওসের বয়স কত জানেন? মাত্রই ৩১।
এই যে একটা ট্রফির জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ছড়ানো, কাতারি স্পোর্টস ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপের মোড়কে আসলে তা কাতারি সরকারের টাকা। ক্লাব ফুটবলে এমন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষণা ঠিক না বেঠিক—এ প্রশ্ন তুলতে পারেন, শুরু করতে পারেন স্পোর্টসওয়াশিং নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনাও। তবে ফাইনালটা দেখে থাকলে এই প্যারিস সেন্ট জার্মেই সব ভুলিয়ে আপনাকে নিশ্চিত নতুন করে আবার ফুটবলের প্রেমে মজিয়ে দিয়েছে। রাঙিয়ে দিয়েছে মন। ১৯৯২ সাল থেকে চ্যাম্পিয়নস লিগ নাম নেওয়া একসময়কার ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনাল এর আগে কখনো তারুণ্যের এমন উচ্ছ্বাস দেখেছে বলে মনে হয় না।
পারফরম্যান্স সব সময় স্কোরলাইনে অনূদিত হয় না। এখানে সেই সমস্যাও নেই। প্যারিস সেন্ট জার্মেই ৫: ইন্টার মিলান ০—এমন স্কোরলাইন এর আগে কখনো দেখেনি চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল। তিনবারের ইউরোপজয়ী যে ইন্টার মিলান এবারের টুর্নামেন্টে নিজেদের আগের ১৫টি ম্যাচে কখনো ১৬ মিনিটের বেশি পিছিয়ে থাকেনি, ক্ল্যাসিক এক সেমিফাইনালে বিদায় করে দিয়েছে বার্সেলোনাকে, পিএসজির সামনে তাদের এমন খড়কুটোর মতো উড়ে যাওয়া এমনই অতিপ্রাকৃত এক অভিজ্ঞতা, চোখে দেখেও যা বিশ্বাস হতে চায় না। ফাইনালের ১৯ বছর বয়সী যে নায়কের কথা বলছিলাম, সেই দেজিরে দুয়ের পাস থেকেই ১২ মিনিটে আশরাফ হাকিমির প্রথম গোল। এটি যদি ইন্টারকে চমকে দিয়ে থাকে, ২০ মিনিটে দুয়ে নিজেই ২-০ করে ফেলার পর যেন হতভম্ব তিন বছরের মধ্যে দ্বিতীয় ফাইনাল খেলা ইতালিয়ান পরাশক্তি। তারুণ্যের যেমন একটা শক্তি আছে, অভিজ্ঞতারও কি নেই! কিন্তু এই ফাইনালের ইন্টার যে অভিজ্ঞতার বদলে শুধু তাদের বয়সটাই মনে করিয়ে গেল সারাক্ষণ। বার্সেলোনার বিপক্ষে উথালপাতাল ওই সেমিফাইনালের দুই লেগই কি তাহলে সব প্রাণশক্তি শুষে নিয়েছে, নাকি পিএসজির তারুণ্যের ওই উন্মাতাল জোয়ারই হাবুডুবু খাইয়ে শেষ পর্যন্ত অথই সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ইন্টারকে!
নইলে ২০ মিনিটে ২ গোল খেয়ে বসার পরও তো ফিরে আসা যায়। কামব্যাকের এমন গল্প ফুটবলে কম নাকি! এখানে উল্টো পিএসজি রঙিন থেকে রঙিনতর। ৬৩ মিনিটে আবারও গোল করে দেজিরে দুয়ের জার্সি খোলা উদ্যাপনে যেন আগাম শিরোপা–উৎসব! জার্সি খোলা মানেই অবধারিত হলুদ কার্ড, বিশ্ব ফুটবলে নতুন তারকার আগমনী বার্তা ঘোষণা করা দেজিরে দুয়ের তখন তাতে থোড়াই কেয়ার!
এর ১০ মিনিট পর আবারও ইন্টারের জালে আরেকবার বল জড়ানো অনেককেই ফিরিয়ে নিয়ে গেল ১৯৯৪ সালের বিখ্যাত সেই ফাইনালে। যেটিতেও ছিল মিলানের একটি ক্লাব। এসি মিলানের প্রতিপক্ষ সেদিন বার্সেলোনা। যে দলের দুই স্ট্রাইকার ব্রাজিলিয়ান রোমারিও আর বুলগেরিয়ান রিস্টো স্টইচকভ সেই মৌসুমে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছেন। এসি মিলান আবার চোটের কাছে হারিয়ে ফেলেছে দুই তারকা ডিফেন্ডার ফ্রাঙ্কো বারেসি আর কোস্তাকুর্তাকে। বার্সেলোনা তাই ফাইনাল শুরু করেছিল প্রবল ফেবারিট হিসেবে। রোমারিও-স্টইচকভ আজ না জানি কী করেন! অথচ এথেন্সের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে যা হলো, গত রাতের ফাইনালের মতোই তা অবিশ্বাসে চোখ কচলে দেখার মতো। মালদিনি অ্যান্ড কোংয়ের কাছে বোতলবন্দী রোমারিও-স্টইচকভ পুরো ম্যাচেই একরকম অদৃশ্য হয়ে থাকলেন আর বার্সেলোনার জালে একে একে বল ঢুকল চার-চারবার!
৩১ বছর পর চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে আবারও ৪-০। এই রাতের পিএসজি তাতেও তৃপ্ত হলে তো! প্যারিসের শহরতলি থেকে উঠে আসা ১৯ বছরের সেনি মায়ুলুর গোলে তাই ৫-০। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে নতুন ইতিহাস গড়া ওই গোলের একটা প্রতীকী তাৎপর্যও হয়তো খুঁজে নিতে পারেন। শুধুই বিদেশি সুপারস্টারদের দিকে না তাকিয়ে প্যারিস সেন্ট জার্মেই এখন নিজেরাই মাঠে সৌরভ ছড়ানোর মতো খেলোয়াড় তৈরি করতে পারছে।
বিখ্যাত সেই ফরাসি সৌরভ!