যে হাটে একদিনে বিক্রি হয় কোটি টাকার পুরোনো মোটরসাইকেল

যে হাটে একদিনে বিক্রি হয় কোটি টাকার পুরোনো মোটরসাইকেল

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা পৌর শহরের রেলস্টেশনসংলগ্ন বাস টার্মিনাল এলাকা। চারপাশে সরগরম পরিবেশ। সারি সারি করে সাজানো শত শত পুরোনো মোটরসাইকেল। একেকটি বাইক বা মোটরসাইকেলের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বিক্রেতা বা দালাল। ক্রেতারা ঘুরে ঘুরে দেখছেন, দর-কষাকষি করছেন, কেউবা বাইক স্টার্ট দিয়ে চালিয়ে যাচাই করে নিচ্ছেন। হাটজুড়ে চলছে যেন কেনা-বেচার প্রতিযোগিতা। এ যেন মোটরসাইকেলের এক অঘোষিত মেলা।

প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার জমে ওঠে দেশের অন্যতম বৃহৎ ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের এই হাট। হাটের আয়তন, কেনা-বেচার পরিমাণ এবং বাইকের বৈচিত্র্যে এটি দেশের অনেক বড় মার্কেট বা শো-রুমকেও ছাড়িয়ে গেছে। হাটজুড়ে চলছে বাইক বেচাকেনার পাশাপাশি মানুষের গল্প, সম্ভাবনা আর কর্মসংস্থানের এক বাস্তব ছবি।

হাটে দেখা মেলে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও মডেলের ৫০-১৫০ সিসির মোটরসাইকেলের। পুরোনো হলেও অনেক বাইকের অবস্থা প্রায় নতুনের মতো। দাম শুরু মাত্র ২০ হাজার টাকা থেকে, আর সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন রকম মোটরসাইকেল।

যে হাটে একদিনে বিক্রি হয় কোটি টাকার পুরোনো মোটরসাইকেল

যে হাটে একদিনে বিক্রি হয় কোটি টাকার পুরোনো মোটরসাইকেল

এক হাটেই কোটি টাকার লেনদেন। হাট পরিচালনা কমিটির হিসাব অনুযায়ী, প্রতি সপ্তাহে এখানে প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০টি মোটরসাইকেল নিয়ে আসেন বিক্রেতারা। তার মধ্যে গড়ে ১০০-১৫০টি মোটরসাইকেল বিক্রি হয়ে যায়। প্রতিটি হাটে প্রায় ১ কোটি টাকা মূল্যের মোটরসাইকেল কেনা-বেচা হয়।

যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা দু’পক্ষই স্বস্তিতে কেনা-বেচা করতে পারেন। মো. রবিউল ইসলাম নামের আলমডাঙ্গার স্থানীয় এক বিক্রেতা বলেন, ‘দুই বছর আগে আমি একটা পুরোনো বাইক কিনে চালিয়েছি। এবার নতুনটা কিনতে চাই, তাই পুরোনোটা বিক্রি করতে এনেছি। এখানে বিক্রি করলে দ্রুত দাম পাওয়া যায়।’

ক্রেতা ইসমাইল হোসেন, চুয়াডাঙ্গা সদরের একটি কলেজের শিক্ষক। তিনি জানালেন, ‘আমার ছেলে কলেজে পড়ে, ওর জন্য একটা মাঝারি দামের বাইক খুঁজছি। এই হাটে অনেক অপশন থাকে, দেখে বেছে নেওয়া যায়। একই ব্র্যান্ডের বিভিন্ন অবস্থা ও দামের বাইক পাওয়া যায়, দর-কষাকষিও করা যায়।’

বেকার যুবকদের জন্য রোজগারের সুযোগ করে দিচ্ছে এই হাট। এই হাটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি বড় ব্যবস্থাপনা। পুরোনো বাইক সংগ্রহকারী, রিকন্ডিশনিং মেকানিক, হাটে বাইক আনা-নেওয়া কর্মী, দালাল, বিক্রেতা ও পার্টস ব্যবসায়ী-সব মিলিয়ে কয়েকশো মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই হাটে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম, মেহেরপুর থেকে প্রতি সপ্তাহেই আসেন বাইক বিক্রি করতে। তিনি বলেন, ‘আমি ৫ বছর ধরে এই হাটে আসি। বাইক কিনে সারিয়ে তুলে এখানে বিক্রি করি। লাভের পরিমাণ কম, তবে নিয়মিত চললে মাসে ভালো আয় হয়। বেকারদের জন্য এই হাট বড় সুযোগ।’

নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলায় অন্যান্য হাটের চেয়ে এগিয়ে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার এই পুরোনো মোটরসাইকেলের হাট। এ হাটে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে কখনো কোনো বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। চুরি, প্রতারণা বা সংঘর্ষের মতো ঝামেলা নেই বললেই চলে।

যে হাটে একদিনে বিক্রি হয় কোটি টাকার পুরোনো মোটরসাইকেল

যে হাটে একদিনে বিক্রি হয় কোটি টাকার পুরোনো মোটরসাইকেল

হাট ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য জিল্লুর রহমান ওল্টু জানান, ‘আমরা নিয়মিত নজরদারি করি। বাইক বিক্রির আগে মালিকানা কাগজ যাচাই করা হয়। সবাইকে নিয়মের মধ্যে চলতে হয়। এ কারণে ক্রেতা-বিক্রেতারা স্বস্তি নিয়ে আসে।’

আলমডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুদুর রহমান বলেন, ‘বিভিন্ন সময় এই হাটে গোপন নজরদারি করি। তেমন কোনো অপরাধমূলক তথ্য পাওয়া যায়নি। জনসচেতনতাই এই হাটের সুশৃঙ্খল পরিবেশ গড়ে তুলেছে।’

চুয়াডাঙ্গা ছাড়াও ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া ও যশোরের বিভিন্ন উপজেলার মানুষ আসেন এখানে। কেবল হাট নয়, এটি এক ধরনের আঞ্চলিক মোটরসাইকেল পুনর্ব্যবহার বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।

স্থানীয়রা বলছেন, ‘ব্যবহৃত গাড়ির সেকেন্ডারি মার্কেট যেমন শহরকেন্দ্রিক ছিল, আলমডাঙ্গার এই বাইক হাট সেটিকে গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে এনে দিয়েছে সফল রূপ। এ ধরনের হাট সরকারি পর্যায়ে নিবন্ধিত হলে কর্মসংস্থান ও রাজস্ব আয়ের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।

আলমডাঙ্গার এই মোটরসাইকেল হাট কেবল একটি সাপ্তাহিক বাজার নয়-এটি হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক আর্থ-সামাজিক গতিশীলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। স্বল্প বাজেটে স্বপ্নপূরণ, উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ এবং একটি নির্ভরযোগ্য বাইক কেনার ঠিকানা সবই মেলে এই হাটে।

আরও পড়ুন