রফিকুল হায়দার ফরহাদ, চর হেয়ার থেকে ফিরে
২০২৩ সালে প্রথম যাওয়া চর হেয়ারে। তখন পর্যটকদের জন্য কিছুই ছিল না। ২০২৪ সালে গিয়ে পাওয়া গেল ভ্রমণ পিপাসুদের বসার জন্য কয়েকটি বেঞ্চ। কিন্তু এবার একেবারেই ভিন্ন চেহারায় পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীর এই সাগর পাড়ের দ্বীপটি। আগেই দু’বার ট্রলার থেকে লাফিয়ে পানিতে ভিজে এরপর তীরে পৌঁছাতে হয়েছিল। আর এবার ট্রলার গিয়ে পৌঁছালো চর হেয়ারকে বিভক্ত করা খালের ধারের ছোট্ট ঘাটে। বনের গাছের ডাল আর কাঠ দিয়ে করা এই ঘাটে অনায়াসেই পর্যটন স্পটটিতে নামতে পারছেন অতিথিরা।
শুধু এই ঘাটই নয় পুরো হেয়ার আইল্যান্ডই এখন বদলে গেছে। আগে বিচ্ছিন্নভাবে ক্যাম্প করে থাকতেন সাহসী পর্যটকরা। এখন সেখানে এই ক্যাম্প করে রাত্রিযাপন করাদের জন্য সব ব্যবস্থাই আছে। তাবু যেমন ভাড়া দেয়া হয়, তেমনি পর্যটকদের জন্য রয়েছে টয়লেট ও টিউবওয়েল। আগে পর্যটকদের সাথে করে খাওয়ার পানি আনতে হতো। একটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থার উদ্যোগে সেখানে এই সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। তাদের এই সহযোগিতায় চর হেয়ারে শুরু হয়েছে লোক বসতিও। পর্যটকদের দেখভালের জন্য এক বছর ধরে একটি দম্পতি সেখানে থাকা শুরু করেছেন। তারা সেখানে পর্যটকদের খাবারের ব্যবস্থা করেন। দিনে জন প্রতি ৬০০ টাকা খাবার বিল নেন। তাবু ভাড়া দেন। গোলপাতা আর বনের কাঠ, ডাল পালা আর প্ল্যাস্টিক দিয়ে তৈরী তাদের একটি দোকান আছে। সেখানে কোমল পানীয় থেকে শুরু করে বিস্কুট, চানাচুর, চিপস সবই পাওয়া যায়। রয়েছে ফ্রিজও। সোলার বিদ্যুতের কল্যাণে রাতে আলোও পান পর্যটকরা। এই বিদ্যুতে মোবাইল চার্জও দেয়া যায়। এবার দুই লাখ পর্যটন এবারে চর হেয়ারে গিয়েছিলেন।
৬ কিলোমিটারের এই চর হেয়ারের সমুদ্র সৈকত হলো সাড়ে তিন কিলোমিটার। এই বিচের পূর্ব দিকে বেঞ্চগুলো পাতা হয়। তা শুধু শীতের মৌসুমেই এই বেঞ্চগুলো থাকে। ঝড় বৃষ্টি শুরু হলেই তুলে ফেলা হয়।
স্বপন বেলাল নামের যে ব্যক্তিটি এই চরে পরিবার নিয়ে থাকেন। তিনি একই সাথে পর্যটন ব্যবসায়ীও। যদিও লেখাপড়ার জন্য তার সন্তানরা থাকেন অন্যত্র নানা বাড়িতে। তার একটি স্প্রিড বোট আছে। তা তিনি ভাড়া দেন। আবার এই জলযানটি তার চর মোন্তাজ থেকে চাল-ডাল-তেল, তরি-তরকারি কিনে আনারও একমাত্র মাধ্যম। তার দেখা-দেখি আরেকজন ঘর করেছেন। তারও দোকান আছে। তিনিও থাকেন পরিবার নিয়ে। তবে নিরীহ জেলে স্বপন বেলাল এখন রাজনীতির শিকার বলে অভিযোগ করেছেন।
আর কিছু মৌসুমী জেলে থাকেন দ্বীপের পশ্চিমাংশে। পর্যটকদের যাতায়াত শুরু বেশ কয়েক বছর আগ থেকেই। তবে এখন এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। বিশেষ করে যারা রাতে এখানে ক্যাম্প করে থাকতে চান তাদের জন্য। আগে মূল সমস্যা ছিল টয়লেট ও খাবার পানি। এখন এর ব্যবস্থা হয়েছে। তাদের জন্য দোলনা আছে, হ্যাবক আছে। বানানো হয়েছে একটি বিশ্রামাগারও। যদিও সেই উপরে ছাদ ও পাশে খোলা এই বিশ্রামাগারের দেয়ালে ফাটল ধরেছে। ফাতরার চর ও চর কুকরি মুকরির বনের বিশ্রামাগারের মতো নির্মাণে দুর্নীতির কারণেই ফাটল।
এক জেলের অভিযোগ সাধারনত যে বালি ব্যবহার করা হয় নির্মাণকাজে সে বালি এখানে ব্যবহার করা হয়নি। হয়েছে সাগর পাড়ের নোনা পানির বালির ব্যবহার। তাই এই দশা।
তাবু টানিয়ে থাকার পাশাপাশি কিছু পর্যটক স্থানীয় জেলেদের পল্লীতেও থাকতে পারেন। তবে এই ক্ষেত্রে পরিচিতরাই অগ্রাধিকার পান। ১০ থেকে ১২ জন লোকের থাকার ব্যবস্থা করতে পারেন জেলেরা। আগে এই চর হেয়ারে অনেক লোক ছিল। তাদের বসতিও ছিল। কিন্তু ২০০৭ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডরে উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক প্রানহানি ঘটেছিল। তখন এই চর হেয়ারেও মানুষ মারা গিয়েছিলেন।
পর্যটকদের দেখা শোনা করা স্থানীয় জেলে স্বপন বেলাল জানায়, মারা যাওয়াদের মধ্যে অন্যত্র থেকে আসা ৮ থেকে ১০ জন জেলেও ছিলেন। আর স্থানীয় বেঁচে যাওয়া অনেকেই অন্যত্র পাড়ি জমান। তবে ১০ থেকে ১২ পরিবার চর হেয়ারের মূল অংশ কলাগাছিয়ার চরে থেকে গেছেন। তাদের অন্যত্র যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। এরা এই চরের পশ্চিমে জলাভূমি এলাকায় চিংড়ি ঘের করে মাছ চাষ করে। সাথে কিছু ধানও চাষ করছে।
এই চর হেয়ারের সাগর পাড়ে ২০২৩ সালে প্রথম যাওয়ার পর দেখা মিলেছিল হরিণের পায়ের ছাপের। তখন বলা হয়েছিল এখানে হরিণ আছে। তবে এখন আর হরিণ নেই বলেও জানান স্বপন বেলাল। বনে প্রানী বলতে কিছু পাতি শিয়াল আর পাখি। এই পাখির মধ্যে কয়েক জাতের বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙ্গা, শালিক, দোয়েল, ঘুঘু অন্যতম। শীতকালে অতিথি পাখিও দেখা যায়। আর সমুদ্র সৈকতে বিচরণ করে বেড়ায় শত শত লাল কাঁকড়া। মাছরাঙ্গা এদের ধরে খায় সুযোগ পেলেই। পর্যটকদের দেখলেই এরা দৌড়ে গর্তে ঢুকে পড়ে। বনের মধ্যে উপকূলীয় এলাকার আবহাওয়া উপযোগী গাছ যেমন কেওড়া, গেওয়া, বাইন, বলই, হরগুজি কাটা, গোলপাতা, খইয়া বাবলাসহ নানান জাতের গাছ থাকলেও সেখানে লাগানো হয়েছে ঝাউগাছ ও আকাশমুনি বা একাশিয়া গাছ। বরই গাছও আছে অনেক। বট, কড়ই গাছেরও উপস্থিতি। কিছু লেবু ও পেয়ারা গাছ লাগানো হয়েছিল। সেগুলো মাটির লবণাক্ততার জন্য মরে গেছে।
তবে অতি উৎসাহী কিছু পর্যটন মৌসুমে রাতে উচ্চস্বরে গান বাজিয়ে হৈ হুল্লোড় করে। এতে বনের পরিবেশ নষ্ট হয়। বন্য প্রানীর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। এই বিষয়গুলো সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখতে হবে।
স্থানীয় ট্যুর কোম্পানিগুলো পর্যটকদের এখানে তাবু টানিয়ে রাতযাপনের জন্য নিয়ে আসে। কেউ ভোলা থেকে কেউ কুয়াকাটা থেকে আসেন। পটুয়াখালীর জনগণতো আছেই।
চর হেয়ারের বিশেষত্ব এটিকে বলা হয় মিনি কুয়াকাটা। এখান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখা যায়। এই চর কলাগাছিয়ার চরের অর্ন্তগত। মাঝের একটি নদী কলাগাছিয়ার চর থেকে এই চরকে বিভক্ত করেছে। এই নদীর নাম নইল্লার কাটাল (কাটাল মানে গভীরতম স্থান)। একই স্থান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ মেলায় এখন পর্যটকদের ঢল নামে চর হেয়ারে। এবারের শীতের সিজনে দুই লাখ পর্যটক চর হেয়ারে গিয়েছিল।
স্বপন বেলাল জানান, এই পর্যটকদের জন্য তিনি তাবু ভাড়া দেন। সিঙ্গেল তাবু ৪০০ টাকা। গ্রুপ তাবুর ভাড়া ৭০০ টাকা। এছাড়া কোনো পর্যটন বিচে ফুটবল খেলতে চাইলে তাদের ফুটবলও সরবরাহ করা হয়। সাইকেলও ভাড়া দেয়া হয় বিচে চালানোর জন্য। আগামীতে মোটরসাইকেলও দেয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানান বেলাল। সিডিইসি এনজিও’র উদ্যোগেই এগুলো দেয়া হচ্ছে। স্বপ্নন বেলালও কিছু টাকা বিনিয়োগ করেছেন পর্যটকদের সেবায়। এতে তার ভালোই লাভ হয়েছে বলে উল্লেখ করলেন। বীচে আলো জ্বালানোর জন্য লাগানো হয়েছে সোলার লাইট।
জানা গেছে, এখন জাগো নারী নামের আরেকটি এনজিওও সেখানে পর্যটকদের সুবিধা দেয়ার বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে চায়।
বেশিভাগ পর্যটকই সাথে করে খাবার নিয়ে আসেন। কারণ চর হেয়ারে নেই কিছুই। আগে অর্ডার করলে স্বপন বেলাল ১০ থেকে ১২ জনের খাবারের ব্যবস্থা করতে পারেন। যদি বিচ লাগোয়া সাগরে কোনো জেলের দল মাছ ধরে তবে তাদের কাছ থেকে মাছ কেনা যায়। যেমনটা গত বছর কিনেছিলাম জেলেদের কাছ থেকে। ১০০ টাকা কেজি দরে ফাইশা মাছ ও ছোট মাছ। যেখানে ছিল একটি ইলিশ, বেশ কয়েকটি লাক্ষা মাছ। সাথে ফ্রি হিসেবে পাওয়া কয়েকটি কাঁকড়া। আমরা আগের দু’বার জেলেদের কাছ থেকে ইলিশ মাছ কিনে চর হেয়ারের সাগর পাড়ে চুলা বানিয়ে বনের শুকনো কাঠ দিয়ে দুপুরের খাবার রান্না করেছিলাম। তখন গত বছর আমাদের মাঝি ভুলক্রমে সাথে করে ভাত-তরকারি রান্না করার মিঠা পানি সাথে আনেনি। পরে সাগরে মাছ ধরতে থাকা অন্য মাঝির কাছ থেকে মিঠা পানি যোগাড় করে রান্না করা হয়েছিল। ভাত ইলিশ মাছ ভাজা ও ডাল ছিল খাবারের উপকরণ।